কুড়িগ্রামের উলিপুরে ভিজিএফ এর ১৫০ বস্তা নিম্নমানের চাল ফেরত
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:১৯ এএম, ১৭ জুলাই,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:০৩ পিএম, ২৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে ঈদ উপলক্ষে দুস্থদের ভিজিএফ এর ১৫০ বস্তা চাল নিয়ে নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। চলছে ব্যবসায়ী ও খাদ্য বিভাগের রশি টানাটানি। এই নিম্নমানের চালগুলোর দায়িত্ব কেউ না নেয়ায় ফিরত দেয়া হয়েছে। সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে উন্নত মানের চাল বের হয়ে তা হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদে পৌছানোর পূর্বেই নিম্নমানের খাওয়ার অযোগ্য পঁচা চালে রুপান্তরিত হলো কি ভাবে এ রহস্যের জট খুলছে না।
আজ শুক্রবার দুপুরে উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদে। হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিএম আবুল হোসেন এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আলাউদ্দিন বসুনিয়া জানান, ঈদ উপলক্ষে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ৮শ ৩ মেঃ টন ৫শ ৬০ কেজি চাল ভিজিএফ এর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। সে অনুযায়ী হাতিয়া ইউনিয়নে বিতরনের জন্য ৬৩ মেঃ টন ২শ ১০ কেজি চাল বরাদ্দ হয়। শুক্রবার দুপুরে সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে হাতিয়া ইউনিয়নের জন্য ভিজিএফ এর বরাদ্দকৃত প্লাষ্টিক বস্তায় খাদ্য মন্ত্রনালয়ের সরকারি সীল মোহরযুক্ত ৫০ কেজি ওজনের চালের বস্তা প্রতি গাড়ীতে ১শ ৫০ বস্তা করে ৬ টি গাড়ীতে ৯শ বস্তা চাল পাঠানো হয়।
হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিএম আবুল হোসেন জানান, সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে ভিজিএফ এর বরাদ্দকৃত চাল ৬টি গাড়ীতে ৯শ বস্তা ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে আসা হয়। পরিষদের গুদামে চালের বস্তা গুলো নামানোর সময় ৫টি গাড়ীর চাল উন্নত মানের হলেও ১টি গাড়ীর ১শ ৫০ বস্তা চাল প্লাষ্টিকের পুরানা বস্তা ও সরকারি সীল না থাকায় সন্দেহ হয়। ওই গাড়ীর বস্তা গুলোর চাল খুবই নিম্নমানের খাওয়ার অযোগ্য পঁচা লাল রঙের চাল হওয়ায় তা সরকারি খাদ্য গুদামে ফেরত পাঠাই। তিনি আরও বলেন, গাড়ী গুলোতে মাত্র দুইজন গ্রাম পুলিশ ছিল। খারাপ চালের বিষয়টি আমি ইউএনও ও খাদ্যগুদাম কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। তারা চালের বস্তা গুলো খাদ্য গুদামে ফেরত পাঠাতে বলেছেন। তাই নিম্নমানের চালের বস্তাগুলো ফেরত পাঠিয়েছি।
নিম্নমানের চাল বহনকারী গাড়ীর চালক নাহিদ ইসলাম বলেন, উলিপুর সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে ১শ ৫০ বস্তা চাল হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে আসি। এরপর চাল গুলো খাবার অযোগ্য হওয়ায় চেয়ারম্যান সাহেব তা নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং আমাকে চালের বস্তা গুলো ফেরত নিয়ে যেতে বলেন। তাই ফেরত আনি।
অনুসন্ধানে দেখা যায়,এই ১শ ৫০ বস্তা নিম্ন মানের চালের দায় দায়িত্ব কেউ নিতে রাজি নন। খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা বলছেন এ চাল আমি গুদাম থেকে সরবরাহ করিনি অপরদিকে গাড়ির চালক বলছেন চালের বস্তা সরকারি গুদাম থেকে আনা হয়েছে। অপর দিকে উপজেলা খাদ্য ব্যবসায়ী ও মিল চাতাল মালিক সমিতির আহবায়ক মাহফুজুর রহমান বুলেট ঝামেলা মুক্ত ভাবে চালের টলি ছাড়িয়ে নিতে এবং বিষয়টি ধামাপাচা দিতে কোমড় বেধেঁ মাঠে নেমেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন খাদ্য ব্যবসায়ী জানান, উলিপুর সরকারি খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা ও ধান চাল ব্যসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন থেকে এ ঘটনা গুলোর সাথে জড়িত। খাদ্য গুদামের কর্মকর্তার যোগসাজশে গুদাম থেকে উন্নত মানের চাল ইউনিয়ন পরিষদ গুলোতে পাঠানোর সময় পথিমধ্যে ওই সিন্ডিকেটের ব্যবসায়ীদের গুদাম থেকে ভালো চাল পরিবর্তন করে নিম্নমানের খাবার অযোগ্য চাল সরবরাহ করেন। যেখানে গুদামের ভাল চালের বর্তমান বাজার মূল্য ৪৪/৪৫ টাকা কেজি, সেখানে নিম্নমানের চালের মূল্য ২০/২৫ টাকা।
ওই সূত্রটি আরও নিশ্চিত করেছেন, হাতিয়া ইউপি থেকে ফেরত ১৫০ বস্তা চাল সরকারি গুদামে না এনে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তাদের গুদামে নামিয়ে নিয়েছে। খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা নিম্ন মানের চালের দায়িত্ব না নেয়ার ফলে ১৫০ বস্তা চাল নিয়ে উপজেলা খাদ্য বিভাগ ও ব্যবসায়ীদের রশি টানাটানি চলছে। ওই সূত্র নিশ্চিত করেন খাদ্য ব্যবসায়ী মাহফুজুর রহমান বুলেট এ নিম্ন মানের চালের মালিক। তিনি কৌশলে চাল গুলো হাতিয়া ইউপিতে সরবরাহ করেছেন।
এ বিষয়ে খাদ্য ব্যবসায়ী ও মিল চাতাল মালিক সমিতির আহবায়ক মাহফুজুর রহমান বুলেট বলেন, নিম্ন মানের চালের মালিকানার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য বার বার অনুরোধ করেন। নিম্নমানের চালের গাড়ীটির ব্যাপারে প্রশাসনের হাত থেকে রক্ষা পেতে কেনো তদবির করেছিলেন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, খাদ্য ব্যবসায়ীদের নেতা হিসাবে আমাকে এটি করতে হয়েছে। ব্যবসায়ীদের সার্থে করেছি।
উলিপুর উপজেলা ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা (ওসি এলএসডি) শাহীনুর রহমান বলেন, খাদ্য গুদাম থেকে ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে বরাদ্দকৃত ভিজিএফ এর চাল সরবরাহ করা হচ্ছে। গুদাম থেকে ভাল চাল পাঠানো হয়েছে। নিম্নমানের চাল সেখানে কিভাবে পৌছিল তা আমার জানা নেই। তবে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। ১৫০ বস্তা নিম্ন মানের চাল ভিন্ন বস্তায় কি করে সেখানে পৌছিল এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাল গুদাম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর বিষয়টি আমার দেখার দায়িত্ব না। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ফেরত পাঠানো নিম্ন মানের চাল পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি সদুত্তর না দিয়ে বলেন এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আলাউদ্দিন বসুনিয়া জানান, এ বিষয়ে কেউ আমাকে কিছু জানায়নি। ওসি এলএসডি (ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা) বিষয়টি সঠিক ভাবে বলতে পারবেন। আমি এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-এ-জান্নাত রুমি বলেন, হাতিয়া ইউনিয়নে খাদ্য গুদাম থেকে নিম্ন মানের চাল সরবরাহের বিষয়ে চেয়ারম্যান আমাকে জানিয়েছেন। আমি ঐ চাল ফেরত পাঠাতে বলেছি। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে এ বিষয়ে আমি কথা বলেছি। কোন ভাবেই নিম্ন মানের চালের বিষয়টি মেনে নেয়া হবে না। এ ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যাবস্থা নেয়া হবে। ঘটনা জানার পর ঐ ইউনিয়ন পরিষদে সরেজমিন পরিদর্শন করেছি এবং (ভিজিএফ এর) ভালো চাল দুস্থদের মাঝে বিতরণ তদারকী করেছি।
কুড়িগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ আবু বকর বলেন, বিষয়টি তার জানা নাই। খাদ্য গুদামে এরকম হওয়ার সুযোগ নেই। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যাবস্থা নিবেন বলে জানান।