বাড়ছে হতাশা, মহামারিতে সংকুচিত চাকরির বাজার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:০১ এএম, ১৩ জুন,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:১০ পিএম, ১৭ নভেম্বর,রবিবার,২০২৪
সম্প্রতি অনার্স অথবা মাস্টার্স শেষ করে বেকারের খাতায় নাম লিখিয়ে নেমেছিলেন চাকরির খোঁজে। কিছুদিন যেতে না যেতেই পৃথিবীজুড়ে শুরু হয়ে যায় করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপ। এরপর সবকিছু ছেড়ে প্রায় বছর দেড়েক ঘরবন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে কয়েক লাখ নতুন বেকারকে। মহামারির কারণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে চাকরির বাজার। নতুন নিয়োগ নেই অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কেমন আছেন বেকার জীবনে পা রেখেই মহামারির কবলে পড়া সেইসব তরুণ-তরুণীরা? তা জানতে এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান মহামারিকালে তাদের ক্যারিয়ারের অনিশ্চিত যাত্রা ও হতাশার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট থেকে অনার্স শেষ করে মাস্টার্স পড়ছিলেন, সঙ্গে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এস এম রাকিব সিরাজী। করোনা মহামারিতে প্রায় দেড় বছর ধরে থমকে আছে তার সব প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনা। রাকিব বলেন, ২০২০ সালের শুরুতেই মাস্টার্স শেষ হয়ে যেত। এতদিনে ক্যারিয়ারও গুছিয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু সব থমকে গেছে। মাস্টার্সও শেষ করতে পারছি না, আবার চাকরি শুরু করবো সেই সুযোগও নেই। গত দেড় বছরে মাত্র একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে পেরেছি। সেটাও ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি।
এদিকে সময় চলে যাচ্ছে, সব মিলিয়ে খুব হতাশ লাগছে। অনেকে জানান, বেকার জীবনে প্রবেশ করার পর তাদের প্রতি পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও কিছুটা বদলে গেছে। রাকিব জানান, মহামারির শুরুর দিকে হল ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন বেশ কিছুদিন। সে সময় পরিবার ও আশেপাশের মানুষ তার বেকারত্ব নিয়ে হতাশা, সঙ্গে কিছুটা বিদ্রুপ প্রকাশ করতে শুরু করে। সেগুলো ভালো না লাগায় আবার ঢাকায় ফিরেছেন। এখন রাজধানীর আজিমপুরে বন্ধুদের সঙ্গে মেসে থেকে চাকরির জন্য পড়ালেখা করছেন। রাকিবের মতো একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন আরও কয়েকজন। যারা করোনার শুরুতে গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেও, আবার ঢাকায় এসে মেসে উঠেছেন। তাদের কেউ কেউ টিউশনি করেন। তবে বেশিরভাগকেই চলার জন্য বাড়ি থেকে টাকা নিতে হয়।
যাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না, প্রতিমাসে টাকা পাঠাতে হিমশিম খেতে হয়, বাড়ি থেকে প্রতি মাসে টাকা নিতে তাদের মধ্যে এক ধরনের অপরাধ বোধ তৈরি হয় বলে জানান কয়েকজন। এই অপরাধ বোধের সঙ্গে চাকরি পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা মিলে তৈরি হচ্ছে হতাশা। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মাস্টার্সের ফলাফল পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী মুস্তাকিম হোসেন। এরপর পুরোদমে চাকরির জন্য চেষ্টা করার প্রস্তুতি ছিল তার। পরিকল্পনা মতো সবকিছু শুরুও করেছিলেন। তবে তিন মাসের মাথায় করোনার আঘাতে থেমে আছে সবকিছু। মুস্তাকিম বলেন, গত দেড় বছরে বিসিএস প্রিলিমিনারি ছাড়া আর কোনো চাকরির পরীক্ষা দিতে পারিনি। বেসরকারি চাকরির জন্যে চেষ্টা করেও পাইনি। ব্যবসা-বাণিজ্য করব, কিন্তু কোনো কিছু শুরু করার জন্য যে মূলধন লাগবে সেটা আমার পরিবারের দেয়ার সামর্থ নেই। এখন যদি কোনো ছোট বেসরকারি চাকরিও পাই, সেটা করে পাশাপাশি সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাব। না হলে টিউশনি করে, বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে হলেও সরকারি চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এই কঠিন সময়েও কেন সরকারি চাকরির জন্যই আশা করে আছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে কয়েকজন বলেন, মহামারির শুরুতে দেশের সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতের চাকরির সুবিধা-অসুবিধা দেখার সুযোগ হয়েছে। সেখান থেকে তাদের কাছে সরকারি চাকরিকেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ ও সমাজে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে।
মুস্তাকিম বলেন, করোনার শুরুতেই দেখেছি, যারা বেসরকারি চাকরি করতেন, তাদের অনেকের চাকরি চলে গেছে। কারও বেতন অর্ধেক করা হয়েছে, আবার কারও বেতন বন্ধ। অন্যদিকে বেশিরভাগ সরকারি চাকরিজীবী ঘরে বসে বেতন নিয়েছেন। তাছাড়া সমাজেও তাদের অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে মাস্টার্স শেষ করে প্রায় দুই বছর ধরে বেকার আছেন জুবায়ের আল মাহমুদ।
তিনি বলেন, শুরুতেই মহামারির কারণে দুই বছর নষ্ট হয়ে গেল। বর্তমানে সরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি খুব একটা হচ্ছে না। এখন পরিস্থিতি ঠিক হলে কিছু দিন সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করবো। তা না হলে ব্যবসা বা উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করবো।
২০১৭ সালে বাংলাদেশে সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, দেশে ২৭ লাখ মানুষ কোনো কাজ করেন না, অর্থাৎ বেকার। শতাংশ হিসাবে বেকারত্বের হার চার দশমিক দুই শতাংশ। এ ছাড়া চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের মূল্যায়নে সারাদেশে ১১টি শিক্ষা বোর্ড থেকে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন শিক্ষার্থী পাস করেছে। এর আগের বছর ২০১৯ সালে মোট ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে নয় লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন পাস করেছে। অর্থাৎ দেশের শ্রমবাজারে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখের মতো নতুন শ্রমশক্তির অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া নতুন বেকারদের দাবি, মহামারি শুরু হওয়ার পর গত দেড় বছরে তাদের পছন্দ ও যোগ্যতা অনুযায়ী আবেদন করার মতো হাতে গোনা কয়েকটি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, বিশ্বজুড়ে মহামারি পরিস্থিতি চলছে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। তবে, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। নিয়োগ পাওয়ার পর গত আট মাসে আমি যতটা সম্ভব নিয়োগের সুপারিশ করেছি। ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি নিয়েছি, ৪২তম স্পেশাল বিসিএসের ভাইভা চলছে। প্রতিদিন ২২০ জনের ভাইভা নেয়া হচ্ছে। রিস্ক নিয়ে এসব কাজ করতে হচ্ছে। পরিস্থিতি রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে না। এখন আমরা যদি ডাক্তার, নার্স নিয়োগ না করি তাহলে চিকিৎসা দেবে কারা। এ নিয়ে নানা সমালোচনা হুমকি-ধমকিও আসছে।
চাকরিপ্রার্থীদের উদ্দেশে পিএসসি চেয়ারম্যান জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যতগুলো পদ খালি ছিল সবগুলোতেই নিয়োগ দেয়া হবে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে সোহরাব হোসাইন বলেন, মহামারির কারণে কারও সময় নষ্ট হয়নি। আমরা হিসাব করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি, যাতে সবাই আবেদন করতে পারেন। পরীক্ষা না হলেও যাদের আবেদনের যোগ্যতা আছে তারা এই সময়ে আবেদন করে রেখেছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যখন পরীক্ষা নেয়া হবে তখন তারা পরীক্ষা দিতে পারবেন। বর্তমান সময়ের চাকরিপ্রার্থী তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অধিকাংশেরই ইচ্ছা সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়ার। তাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরি। দু-একজন অবশ্য ব্যবসা বা উদ্যোক্তা হওয়া ইচ্ছার কথাও জানিয়েছেন। মানবসম্পদ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক পরামর্শদানকারী প্রতিষ্ঠান গ্রো এন এক্সেলের প্রধান নির্বাহী ও মুখ্য পরামর্শক এম জুলফিকার হোসেন বলেন, মহামারি শুরু হওয়ার আগেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা শুনেছিলাম। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য আইটি ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের মতো ডিজিটাল স্কিল দরকার। যারা চাকরি খুঁজছেন, এই বিষয়গুলোতে দক্ষতা থাকলে তাদের সামনে অনেক সুযোগ আছে। দেশের জব মার্কেট এই খাতে প্রাথমিক বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে বেশ এগিয়ে গেছে। তবে ডিজিটাল স্কিল তৈরিতে আমাদের আরও বেশি অ্যাডাপ্টেবল ও ফ্লেক্সিবল হতে হবে। দেশে যে পরিমাণ চাকরির সুযোগ আছে, তাতে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৪৭ শতাংশ গ্রাজুয়েটের চাকরি পাওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান জুলফিকার হোসেন।
তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে দেশের রিটেইল সেক্টরে, যেমন হোম ডেলিভারির মতো কাজে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে এসব চাকরিতে বেতন কম হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন করা শিক্ষার্থীরা সেগুলোতে খুব একটা আগ্রহী না।