রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক আঁতাত ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গণমাধ্যমের বিকাশে অন্তরায় - টিআইবি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:০৮ এএম, ৩ মে,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:০৯ এএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
গণমাধ্যমের প্রকৃত স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। আগামীকাল ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস-২০২১ উপলক্ষে আজ রবিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ আহ্বান জানায় টিআইবি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিগত এক দশকে দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও একদিকে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক আঁতাত আর অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শৃঙ্খল মুক্ত সাংবাদিকতা, গণমাধ্যমের পেশাদারিত্ব ও স্বাধীন তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে উঠেছে। মুক্ত গণমাধ্যম এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে অবিলম্বে স্বাধীন ও পেশাদার গণমাধ্যমের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিতের আহ্বান জানায় টিআইবি। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, করপোরেট পুঁজির সুরক্ষায় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় তার অনুমোদনের ফাঁদে, দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক কাঠামো নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকদের পেশাগত ও জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ঝুঁকির নতুন সব উদহারণ তৈরি করেছে। কোভিড-১৯ মহামারিকালে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের পেশাগত ও অর্থনৈতিক এই ঝুঁকি আরও প্রকট হয়েছে। বহু গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অসংখ্য সাংবাদিক চাকরিচ্যুত কিংবা পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদানের পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন নানামুখী চাপ ও বিধিনিষেধের বেড়াজালে সাংবিধানিক এই অধিকার মলাটবদ্ধ নথিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আর মুক্ত গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারার ব্যর্থতা সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে যেমন দুর্বল করেছে, তেমনি জনগণের অবাধ ও নিরপেক্ষ তথ্য লাভের অধিকার খর্ব করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমের মালিকানা ব্যবসায়ীদের হাতে। এই ব্যবসায়ী মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে ‘মিডিয়া ক্যাপচার’ বা ‘গণমাধ্যম জবরদখল’ এখন বলতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়েছে। ফলে পেশাদার সাংবাদিকরাও অনেক ক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষায় সংবাদ প্রচার কিংবা গোপন করতে বাধ্য হচ্ছে এবং পেশাগত দায়বদ্ধতা নিশ্চিতে ব্যর্থ হচ্ছে; যা মুক্ত গণমাধ্যমের বিকাশই শুধু বাধাগ্রস্ত করছে না, গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটও প্রকট করে তুলেছে। সর্বশেষ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ১৫২তম অবস্থান এবং বিশ্ব মতপ্রকাশ প্রতিবেদনে ১৬১টি দেশের মধ্যে ১৩২তম অবস্থান দেশের গণমাধ্যমের নাজুক পরিস্থিতি প্রমাণ করে। বিশেষ করে, গত এক দশকে এই দুই সূচকেই বাংলাদেশের নিম্নক্রমে স্থির অবস্থান কিংবা ক্রমাবনতি পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে নির্দেশ করে।’ ড. জামান বলেন, ‘তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতে এ বছর বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিপাদ্যÑ ‘তথ্য জনগণের পণ্য’ (ইনফরমেশন অ্যাজ এ পাবলিক গুডস) হলেও বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে সরকারের একাংশের মানসিকতা হলোÑ ‘তথ্য সরকারি সম্পত্তি’; এর নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতেই থাকবে এবং সরকার যেভাবে যতটুকু তথ্য প্রকাশ করতে চাইবে ততটুকুই প্রকাশিত হবে, যা জনগণের জানার অধিকার খর্ব করার পাশাপাশি মুক্ত গণমাধ্যমের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ অতিমারিকালে সাংবাদিকদের তথ্যের অভিগম্যতা এবং মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহে প্রতিকূলতা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও স্পর্শকাতর প্রতিবেদন প্রকাশের সুযোগ সংকুচিত করেছে। আবার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের গ্যাঁড়াকলে সংবাদ কিংবা তথ্য প্রকাশের দায়ে গণমাধ্যম, সাংবাদিক, লেখক, কার্টুনিস্টদের বিরুদ্ধে মামলা, নির্যাতন-নিপীড়ন এবং কারান্তরীণ অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও অবাধ তথ্য প্রবাহের সাংবিধানিক ও আইনি প্রতিশ্রুতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের নামান্তর। অথচ কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ভ্যাকসিনের মতোই জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করে গুজব ও ভুয়া তথ্যের নিয়ন্ত্রণে মুক্ত সাংবাদিকতাই হতে পারতো কার্যকর ভ্যাকসিন।’ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্য লাভের অধিকার টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ১৬-এর সঙ্গে বিশেষ করে লক্ষ্যমাত্রা ১০ অর্জনে সরাসরি প্রাসঙ্গিক উল্লেখ করে ড. জামান আরও বলেন, ‘উন্মুক্ত ও অংশীদারিত্বমূলক নীতিকাঠামো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা তথ্যে অভিগম্যতা, তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে এসডিজি অর্জনে কার্যকরভাবে সহায়ক। তাই ব্যবসা ও রাজনীতির অশুভ আঁতাতের জাল ছিন্ন করে মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে; গণমাধ্যম ও তথ্যপ্রকাশ সংক্রান্ত জ্ঞান বৃদ্ধি করতে হবেÑ যাতে ‘জনগণের পণ্য’ হিসেবে তথ্য প্রাপ্তির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়।