ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা
প্রকাশ: ০২:২৬ এএম, ১৮ জানুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০২:৩৪ এএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
বাংলাদেশে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের অভিযোগে গত বছর ১০ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী র্যাব ও এর সাত বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর ফলে সংশ্লিষ্টরা মার্কিন ভিসা পাবেন না এবং এদের কারো যদি মার্কিন ভিসা থেকে থাকে তবে তা-ও বাতিল হয়ে যাবে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে এদের কারো যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো সম্পদ থেকে থাকে, তা-ও বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে- গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, ভিন্নমত দলন, গণতন্ত্রহীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীতা হরণ প্রভৃতি।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অনেক আগে থেকেই সতর্ক করে আসছিল; কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সেসব সতর্কবার্তা আমলে তো নেয়ইনি, বরং শুরুতে বেশ দম্ভের সাথেই সিনাজুরি করেছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র কিংবা রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র বিশেষে ওই সব দেশ যে ভাষায় কথা না বলে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে তেমন ভাষায়ই কথা বলতে শুরু করে। এসব কথায় যে ভাষা ব্যবহার করা হয়, তা রীতিমতো শিষ্টাচারবহির্ভূত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন তো বটেই, এমনকি অনুল্লেখযোগ্য মন্ত্রীরাও যুক্তরাষ্ট্রকে এক হাত নিয়ে ছেড়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে যে, বাংলাদেশে ৬০০ লোক গুম হয়েছে। ঝটপট জবাবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলে বসলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর নাকি ছয় লাখ লোক গুম হয়। বেশ পরে যখন বুঝতে পারলেন যে, অঙ্কটা বেশি বড় হয়ে গেল, তখন বললেন, এক লাখ লোক গুম হয়। ক্রসফায়ার সম্পর্কে তিনি বললেন, যুক্তরাষ্ট্রেও ক্রসফায়ারে মানুষ মারা যায়। তারা ক্রসফায়ারকে ভিন্ন নামে ডাকে। কোনো ব্যক্তির দোষের কথা বলা, কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা নাকি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ‘ঢং’। এ নিয়ে মার্কিনবিরোধী একটি শোরগোল তুলে ফেলল সরকার। সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে একেবারে দেখিয়ে দিয়েছে- মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠিয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার বিরুদ্ধে কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছে। তাতে পরিস্থিতি উন্নতির আশা তিরোহিত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতর আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কেন পাল্টা ব্যবস্থা নেবে না সরকার; যেন তারা পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা রাখে।
বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন যে এমন একটা ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল আগে থেকেই। গত ৯-১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র শতাধিক দেশে যে গণতন্ত্র সম্মেলন ডেকেছিল, তাতে আমন্ত্রণ জানায়নি বাংলাদেশকে। সেটি ছিল প্রথম ধাক্কা। তখন আব্দুুল মোমেন বললেন, যুক্তরাষ্ট্র কম গণতন্ত্রের দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এবার আমন্ত্রণ জানায়নি, আগামীতে নিশ্চয়ই জানাবে। তবে কি আগামীতে বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্রের নাম নিশানাও মুছে ফেলা হবে?
এই নিষেধাজ্ঞার পর প্রথম দিকে হ্যান করেছে, ত্যান করেছে বললেও আমরা সরকারি বাকোয়াজি থেকেই জানতে পারলাম যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভালো সম্পর্ক করার জন্য আট বছর আগে থেকেই সরকার টাকা খরচ করে লবিস্ট (তদবিরকারী) নিয়োগ করেছে। এখন আরো একদল নতুন লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী মহলে তদবির করে সরকারের সাথে মার্কিন প্রশাসনের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। এ জন্য তিনজন সিনিয়র মন্ত্রীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা হলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এই তদবিরে কোনো কাজ হবে কিনা বলা মুশকিল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এককথার মানুষ। তিনি বরাবর বলে আসছেন যে, কেউ গুমটুম হচ্ছে না। পারিবারিক কলহে বা ঋণগ্রস্ততার কারণে কেউ কেউ আত্মগোপনে যাচ্ছেন, আবার ফিরে আসছেন। তার অঙ্ক বড় সরল; কিন্তু তিনি কি দেখেন না যে, সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে গুম হওয়া পরিবারের শত শত মানুষ রাজপথে সমবেত হয়ে তাদের স্বজনদের ফেরত চাইছেন?
গুম হওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশকেই তুলে নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। এসব পরিবার সমবেত হয়ে কান্নার ধ্বনি তুলছে, যাতে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছে। মা তার সন্তানের ছবি হাতে নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি তোলছেন। শিশুসন্তান পিতার ছবি হাতে নিয়ে কাঁদছে অঝোর ধারায়। বোন খুঁজছেন তার ভাইকে। এর সবই কি তবে মিথ্যা?
এ দিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে,
সরকার সম্ভবত আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর গুমের ঘটনা আড়াল করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ সম্পর্কে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর এমন আচরণ সম্পূর্ণ বেআইনি। দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা এবং গুমের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা জোরদার করার পরিবর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর এ ধরনের তৎপরতা অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু এসব অপতৎপরতার মধ্য দিয়ে সরকার আরেক দফা নিজের বিপদ বাড়াবে বলেই মনে হয়। ভাবমর্যাদা তাতে পুনরুদ্ধার হবে না |
বাংলাদেদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও গুমের বিষয়ে ২০২১ সালে জাতিসঙ্ঘ, দাতাদেশ ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উত্থাপিত উদ্বেগ খারিজ করে দিয়েছে। সরকার ২০২১ সালে এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো ইচ্ছাই তাদের নেই। এইচআরডব্লিউ তাদের ২০২২ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে এসব কথা বলেছে। বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। এইচআরডব্লিউ ১০০ দেশের মানবাধিকার পর্যালোচনাকালে ‘মানবাধিকার’ লঙ্ঘনের ঘটনা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে হয়রানি ও কণ্ঠরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকার নাগরিক অধিকারকর্মী, সাংবাদিক এমনকি শিশুদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এরা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকারি পদক্ষেপের সমালোচনা করেছিল।
সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যান্ড অ্যাডামস বলেন, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ একটি হতাশাজনক বার্তা দিয়েছে যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমালোচনার শাস্তি দেয়া হবে। আর এজন্য তারা কোভিড-১৯ মহামারীকে ব্যবহার করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত আগস্টে তারা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। ওই রিপোর্টে ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের কথা তুলে ধরা হয়। যদিও সরকার এ অভিযোগ অস্বীকার করে। এর আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের টম ল্যানটস হিউম্যান রাইটস কমিশনে যে অভিযোগ তুলেছিল, বাংলাদেশ তা-ও অস্বীকার করে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জোর করে গুমের শিকার কিছু মানুষের পরিবার বলছে যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নিয়ে গেলে পুলিশ তা আমলে নেয় না। কিন্তু পরিবার হুমকি ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। সরকারের চারদিকে যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে তখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার এক নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে। সরকার প্রমাণ করতে চাইছে, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে কেউ কখনো গুমই হয়নি। তাই সরকার গুম হওয়া ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি পুলিশ পাঠিয়ে তাদের কাছ থেকে সাদা কাগজে জোর করে স্বাক্ষর নেয়ার চেষ্টা করছে। পুলিশ বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের স্বজনদের জেরা ও চাপ প্রয়োগ করছে বলে অভিযোগ। কাউকে কাউকে থানায় ডেকে পাঠানো এবং ক্ষেত্রবিশেষে সাদা কাগজে সই নেয়া বা সই দিতে চাপ দেওয়ার অভিযোগও আছে।
এমন ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বৃহস্পতিবার গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের মঞ্চ ‘মায়ের ডাক’ ও মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) পৃথক বিবৃতি দিয়েছে। ভুক্তভোগী এমন পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেছে ঢাকার একাধিক সংবাদপত্র। একটি পরিবার থাকে রাজধানীর বাসাবোর আহমেদনগরে। পরিবারের ছেলে সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহবুব হাসান ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্ব^র থেকে নিখোঁজ। মাহবুবের ছোট ভাই শাকিল খান বলেন, ১০ জানুয়ারি সবুজবাগ থানা থেকে তাকে ডেকে পাঠায়। ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার কাগজপত্রসহ থানায় যাওয়ার পর পুলিশের সদস্যরা তার সাথে বাসায় যান। পুলিশ তখন জানায় যে, শাকিলের বাবা যেহেতু মাহবুবের গুমের ঘটনায় থানায় জিডি করেছিলেন তাই তার সাথে কথা বলতে চায়। শাকিল অভিযোগ করেন, পুলিশ সদস্যরা বাসায় গিয়ে একটি কাগজে তার ৭৫ বছর বয়সী বাবার কাছ থেকে জোর করে সই নেয়ার চেষ্টা করেন। তার বাবা সই দিতে অস্বীকার করলে সাত-আটজন পুলিশ সদস্য তাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেন। এ বিষয়ে সবুজবাগ থানার ওসি মুরাদুল ইসলাম বলেন, অভিযোগ সত্য নয়। এমনিই আমরা মাহবুব হোসেনের ভাইকে ডেকেছিলাম। অনেক দিন ধরে নিখোঁজ, আমরা তো খোঁজখবর নিতেই পারি।
কারো কারো বাসায় পুলিশ একাধিকবার যাচ্ছে বলে ভুক্তভোগী আরো চারটি পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে একজন বেবী আক্তার। তার স্বামী ছাত্রদল নেতা তরিকুল ইসলামকে প্রায় ১০ বছর আগে পল্লবীর বাউনিয়া বাঁধ থেকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে একদল লোক তুলে নিয়ে যায়। বেবী আক্তার বলেন, তাদের পরিবারকে পুলিশ ডেকে পাঠায়। গত বুধবার রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত থানায় তাদের বসিয়ে রাখা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে পুলিশ এসে তাদের কাছ থেকে তরিকুল গুম হওয়ার পর থানায় জিডি এবং পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠানো চিঠির অনুলিপি নিয়ে যায়।
২০১০ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে দিয়ে গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলামের বোন সানজিদা ইসলাম বলেন, তাদের বাড়িতেও পুলিশ কয়েকবার গেছে। তার মায়ের সাথে কথা বলেছে এবং তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে কী কী মামলা ছিল সে খবর জানিয়ে গেছে। নোয়াখালী থেকে গুম হওয়া আলমগীর হোসেনের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার বলেন, তাকে থানায় ডেকে পুলিশ কথা বলেছে।
এই ধারা চলছে। সরকার সম্ভবত আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর গুমের ঘটনা আড়াল করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ সম্পর্কে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর এমন আচরণ সম্পূর্ণ বেআইনি। দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা এবং গুমের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা জোরদার করার পরিবর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর এ ধরনের তৎপরতা অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু এসব অপতৎপরতার মধ্য দিয়ে সরকার আরেক দফা নিজের বিপদ বাড়াবে বলেই মনে হয়। ভাবমর্যাদা তাতে পুনরুদ্ধার হবে না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com