৩০৯২ কোটি টাকা দেনা রেখে ৩২৮ কোটির রেকর্ড লাভ দেখাল বিমান!
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:২৩ এএম, ২৩ জুন,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:৪৪ এএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স থেকে অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল মিলে তিন হাজার ৯২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক)। কিন্তু পাওনা পরিশোধ না করেই চলতি বছর সর্বোচ্চ লাভ দেখিয়েছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠানটি! বিমান বলছে, গত দুই বছরে তারা বেবিচকের কোনো ধরনের চার্জ বকেয়া রাখেনি। পরিশোধ করেছে জেট ফুয়েলের (পদ্মা অয়েল) সব খরচ। তবে, এর আগের বকেয়া পরিশোধের পরিকল্পনা নেই তাদের।
অন্যদিকে বেবিচক বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কাছে তাদের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা পাওনা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তিন হাজার ৯২ কোটি টাকা আটকে রেখেছে বিমান। বিপুল অঙ্কের এই দেনা পরিশোধের চিন্তা ছাড়াই টানা দ্বিতীয় বছরের মতো লাভ দেখিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ১৫৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা নিট লাভ দেখায়। ২০২১-২২ অর্থবছরের আট মাসে (ফেব্রুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত) প্রতিষ্ঠানটি লাভ দেখায় ৩২৮ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ৩২৪ কোটি টাকা মুনাফা করে। গত ১২ বছরের হিসাব করলে এটাই বিমানের সর্বোচ্চ মুনাফা। তবে, বেবিচকের দেনার বিষয়ে তথ্য নেই তাদের কাছে।
বিমানের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘বেবিচকের দেনা বাদ রেখে বিমানের লাভ-ক্ষতি হিসাবের কোনো সুযোগ নেই। একটি এয়ারলাইন্সের খরচের ৫০ ভাগই যায় বেবিচকের চার্জ ও তেলের দামের পেছনে। এই দেনা বাদ দিয়ে লাভ-ক্ষতির হিসাব করতে গেলে সেটা কিন্তু জাস্টিফায়েড (ন্যায়সঙ্গত) হবে না। বুঝতে হবে তারা লাভটা টুইস্ট করছে। পৃথিবীর সব দেশের এয়ারলাইন্সগুলো তাদের আর্থিক প্রতিবেদন পাবলিকলি (সর্বসমক্ষে) প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশে এটা করা হয় না। সেক্ষেত্রে তাদের লাভ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। ২০০৮ সালে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকার পাহাড়সম দেনায় পড়ে বিমান। ওই সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করে ১২১৬ কোটি টাকার সারচার্জ মওকুফ পায় প্রতিষ্ঠানটি। বাকি ৫৭৩ কোটি টাকা পরিশোধ করে দায়মুক্তি পায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। ২০২১-২২ অর্থবছরের আট মাসে রেকর্ড পরিমাণ লাভের বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল বলেন, ‘সময়োপযোগী প্রণোদনা পেয়েছিলাম। আমরা তা যথোপযুক্ত কাজে লাগাতে পেরেছি। বিমানে সব ধরনের মিতব্যয়িতা অবলম্বন করা হয়েছে। এছাড়া বিমানের কিছু পাওনা ছিল, সেগুলো আদায় করা হয়েছে। এছাড়া টিকিট কারসাজি বন্ধে আমরা একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছি। সেখান থেকেও টাকা আয় হয়েছে।’
এদিকে বেবিচকের দেনা পরিশোধ না করেই একের পর এক বিমান ক্রয় এবং নতুন নতুন রুট চালু করছে বিমান। ২০২১ সালে সর্বশেষ চারটি ড্যাশ- ৮ মডেলের উড়োজাহাজ নিজ বহরে যুক্ত করে তারা। এগুলোর নাম দেয়া হয় ‘ধ্রুবতারা’, ‘আকাশতরী’, ‘শ্বেতবলাকা’ ও ‘হংসমিথুন’। এছাড়া ২৮ জুন থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঢাকা-টরেন্টো রুটে নিয়মিত ফ্লাইট চালু করবে বিমান। পাশাপাশি জাপানের নারিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ফ্লাইট চালানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বেবিচকের পাওনার বিষয়ে বিমানের এমডি বলেন, ‘পুরোনো বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কথা বলতে চাই না। তবে, গত দুই বছরের বেবিচকের সব পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি টাকার মধ্যে অ্যারোনটিক্যাল চার্জগুলো রিকনসিলিয়েশন (সমন্বয় সাধন) করার জন্য আমরা বেবিচককে ৩২ কোটি টাকা দিয়ে রেখেছি। এটা হয়ে গেলে পুরোনো পাওনাগুলোও আপডেট হয়ে যাবে।
বেবিচকের নিট মুনাফায় বিমানের দেনার প্রভাব: বেবিচকের অধীনে বর্তমানে তিনটি আন্তর্জাতিকসহ মোট আটটি বিমানবন্দর রয়েছে। তাদের আদায় করা অ্যারোনটিক্যাল চার্জগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিমানের ল্যান্ডিং চার্জ, রুট নেভিগেশন সার্ভিস চার্জ, বোর্ডিং ব্রিজ ব্যবহার চার্জ ও এমবারকেশন। নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জগুলো হলো- গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, চেক-ইন কাউন্টার ভাড়া, কার পার্কিং ও এভিয়েশন ক্যাটারিং সার্ভিস।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক যুগ ধরে বিমানের বকেয়া টাকা পড়ে থাকায় এর প্রভাব পড়ছে বেবিচকের রাজস্ব আয় ও নিট মুনাফায়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেবিচকের নিট মুনাফা ছিল ৬১১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ২৯২ কোটি টাকায়। ২০২১-২২ অর্থবছরের আট মাসে তা ঠেকে ১১৮ কোটি টাকায়। বিমানের বকেয়ার বিষয়ে বেবিচক পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘বিমান যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান, আমরা তাদের কেবল বলেই যাচ্ছি। আইন ও বিধি অনুযায়ী আমরা তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছি। তবে, তারা (বিমান বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ) বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে যাচ্ছে।’
সম্প্রতি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে পাইলট নিয়োগের অনিয়ম খতিয়ে দেখে বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ক্যাপ্টেন হিসেবে বোয়িং ৭৭৭ ও বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ পরিচালনার জন্য নির্ধারিত ঘণ্টা ফ্লাই করার অভিজ্ঞতা থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে, বিমানে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের নির্ধারিত ফ্লাইং আওয়ারের অভিজ্ঞতা নেই। কেউ কেউ ক্যাপ্টেন হিসেবে কয়েকবার পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হয়েছেন। আবার কেউ আগের এয়ারলাইন্স থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। কারও কারও বয়স আবার ৬০ এর অধিক।
অন্যদিকে, নিয়োগ পাওয়া ফার্স্ট অফিসারদের যোগ্যতা ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ক্যাপ্টেন ও ফার্স্ট অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে উপযুক্ত জ্ঞান, দক্ষতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসূচক যাচাই-বাছাই করে ত্রুটিমুক্ত প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।