সাধারণ মানুষই বদলে দিচ্ছে বাংলাদেশ
প্রকাশ: ০২:৪৮ এএম, ৯ জানুয়ারী,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:০৩ পিএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
২০০২ সাল থেকে কয়েক বছর ধরে বিটিভিতে ধারাবাহিকভাবে একটি প্রোগ্রাম করেছিলাম। শিরোনাম ছিল ‘বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। আমরা ক্যামেরা নিয়ে দেশের পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছি। যেখানেই দেখেছি মানুষ নিজের উদ্যোগে কিছু করার চেষ্টা করছে, সেখানেই থেমেছি। দেখেছি, আসলে মানুষ অবিরাম সৃষ্টিশীল ধারণা নিয়ে কাজ করছে। উৎপাদন বাড়াচ্ছে, আয় বাড়াচ্ছে, জীবনযাপনের মান বাড়াচ্ছে। সরকারের সাহায্য-সহযোগিতার ধার ধারছে না। একজন একটা লাভজনক উদ্যোগ নিলে আরো দশজন তাকে অনুসরণ করছে। ফলে কোনো কোনো এলাকার নাম হয়েছে নার্সারি গ্রাম। কোনো এলাকার নাম হয়েছে লতির গ্রাম। কোথাও একফসলি জমিতে ফলছে কেউড়া ফসল। উপজাতীয়রা পুষছে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল। আগে যেসব এলাকার নারীরা কৃষি জমিতে হাত লাগাতো না, তারাও মাঠে নেমে পড়েছে পুরুষের পাশাপাশি।
রংপুরের ছোট একটি গ্রাম্য বাজারের কথা বলি। সে এলাকায় ঢুকতে চোখে পড়ল সারি সারি দশ টনি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। বাজার বলতে ১০/১২টি ছোট ছোট দোকান। চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা। কেউ কেউ চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে নরম করে খাচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর থেকে দেখলাম, গ্রামে রিকশায়, বাইসাইকেলে কিংবা পলিথিন ব্যাগে করে সবাই নিয়ে আসছে শুধুমাত্র কচুর লতি। ছোট দু’একজন দোকানদার কেজিতে কিনছেন। এভাবে টনকে টন কচুর লতি জমেছে বাজারে। বড় বড় পাল্লায় ওজন হচ্ছে। ট্রাকে উঠছে। তারপর দূরের গন্তব্যে যাচ্ছে এক একটি ট্রাক।
এত কচুর লতি কোথায় যায়? ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরে তো যাই। আর বিদেশেও রফতানি হয় প্রচুর। যেখানেই বাঙালি আছে, সেখানেই কচুর লতির চাহিদা আছে। প্রথমে কয়েকজন শখের লতি বাজারে বিক্রি করতে আসতেন। তারপর এক তরুণ উদ্যোগ নিলেন, কচুর লতি এলাকার বাইরে পাঠানোর উদ্যোগ নিলেন। শেষে একজন উদ্যোগ নিলেন মধপ্রাচ্যে রফতানির। রফতানি হতে শুরু করল বৃটেন ও ইউরোপীয় দেশে। এ লতি লন্ডনেও খেয়েছি। মদিনাতেও খেয়েছি। যাই হোক সকাল ১১টা-সাড়ে ১১টার মধ্যে বাজার পরিষ্কার। চায়ের দোকানগুলো ছাড়া বাকি সব শুনশান হয়ে পড়ল।
লতির গ্রামের খবর টিভিতে প্রচারের পর খবর পেলাম নার্সারি গ্রামের। এক যুবক ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রিতে পাস করে চাকরি না পেয়ে গ্রামে চলে যায়। সেখানে যেটুকু পৈতৃক জমি ছিল তাতে নার্সারি খুলে বসেন। বিভিন্ন ধরনের গাছের চারা রোপণ করেন। দুই লাখ টাকা আয়। এরপর নার্সারির জমি আরো বাড়িয়েছেন তিনি। তার দেখাদেখি এখন পুরো গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকায় শুধু নার্সারি আর নার্সারি। অন্য ফসল নেই বললেই চলে। দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা আসছেন। ট্রাক, ভ্যানগাড়ি ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছেন ফল কিংবা কাঠের গাছের চারা। আছে বিভিন্ন ধরনের ফুলও। যেখানেই ঘুরছি, সবাই বলেছেন এক কথা ভালো আছি। লাভে আছি। কেউ বলেননি সরকারের টাকা পেলে, ঋণ পেলে আরো ভালো হতো। তারা সবাই নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য বদলানোর লড়াই করছেন।
আমাদের দেশে কেউড়া ফসলের প্রবর্তক উবিলীগের প্রতিষ্ঠাতা কবি ফরহাদ মজহার। প্রথম উদ্যোগে একই জমিতে একই সঙ্গে তিন-চারটা ফসলের আবাদ। দ্বিতীয় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে শাক-সবজি চাষ। আগে আখের জমিতে শুধু আখই হতো। ফরহাদ মজহারের নয়া কৃষি আন্দোলনে সেখানে লাগানো হতে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি, মিষ্টি কুমড়া। আল বরাবর লাগিয়ে দেয়া হয় ধনে পাতা। সবই অর্থকরি। আখ বড় হতে হতে অন্যসব ফসল ঘরে তোলা যায়।
আমি এক এনজিও’র পরামর্শক হিসেবে গঙ্গাচড়ায়ও কাজ করেছি। শুরুর দিকে দেখতাম ধানের জমিতে শুধু ধান। কিন্তু চাষিদের মোটিভেশনের মাধ্যমে আল বরাবর কঞ্চির জাংলা তুলে সেখানে লাগানো হলো ঢ্যাঁড়শ, শিম, বরবটি, তার নিচ দিয়ে ধনে পাতা। সে সময় মনে হতো আমি যেন নতুন শস্যের তাজা ঘ্রাণ পাচ্ছি। এছাড়া মানুষ আস্তে আস্তে গাছ লাগাতেও শুরু করেছে। সবুজ হয়ে উঠেছে গঙ্গাচরা।
কুমিল্লার এদিকে হোমনায় এক বাজারে দাঁড়ালাম একদিন। হাটবার। বাজারের শেষ প্রান্তে শ’ দেড়েক গাছের চারা নিয়ে বসে আছেন একজন সাধারণ চাষি। পরনে লুঙ্গি ও হাতাঅলা গেঞ্জি। ব্যস্ত। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় আপনার নার্সারি। বললেন, না বাবা, জায়গা জমি নেই। বাড়ির সঙ্গে ছোট একটি পালান। সেখানেই নার্সারি তৈরি করেছি। চলছে কোনোরকম। ছেলেমেয়ে ক’জন? তিনজন। বড় দুটি মেয়ে। ছোটটা ছেলে। চাপকল দিয়েছেন আগেই। গত বছর করেছেন স্যানিটারি ল্যাট্রিন। বড় মেয়ে কী করে? এবার ম্যাট্রিক দিল। বিয়ে দিয়ে দেবেন? এ কথায় ক্ষেপে গেলেন তিনি। বললেন, কেন বিয়ে দেব কেন? আপনাদের ছেলে মেয়েরা বিএ-এমএ পাস করবে। আমার মেয়ে করতে পারবে না কেন? ও যতদূর পড়তে চায়, পড়াবো।
এখন ঢাকার রাস্তায় বের হলে দেখা যায়, অসাধারণ সুদৃশ্য সব হোগলার ঝুড়ি। সেগুলো বেশ জায়গা সাশ্রয়ী এবং প্রয়োজনীয়। একটা বড় হোগলার ঝুড়ির মধ্যে হয়ত মিলবে পাঁচটা ঝুড়ি। বড় থেকে ছোট, একটার ভিতরে আর একটা। কোনো কোনোটার প্রাকৃতিক রঙ, কোনো কোনোটা আবার সুদৃশ্য রঙিন। নিশ্চয়ই দেশে বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। হয়ত গ্রামকে গ্রাম স্বাবলম্বী হয়ে গেছে এই হোগলার ঝুড়ি তৈরি করে। আসলে মানুষ সৃষ্টিশীল। নিজের ভাগ্য নিজেই বদলায়। সরকারের মুখের দিকে চেয়ে থাকে কম।
সমাজ বদলে দিচ্ছে এ রকম লক্ষ কোটি মানুষ। শুধু সমাজ নয়, তারা বদলে দিচ্ছে নিজেদের জীবনমান। তাই এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠছে গরু-ছাগলের খামার, হাঁস-মুরগি পালন বেড়েছে, স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে। বাংলাদেশে এ রকম বাড়ি খুব কমই পাওয়া যাবে যেখানে সেনিটারি লেট্রিন নেই। দিনমজুরের সন্তানরাও স্কুলে যায়। সেতু নেই। নিজেরাই সাঁকো বানিয়ে খাল পার হয়। সে দৃশ্য দেখলেও মন ভরে যায়।
কোভিড মহামারির কারণে এক বছর ঘরবন্দী। কিন্তু ক’দিন আগে বের হয়েছিলাম শ্রীপুরের দিকে। সেখানে ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যার সঙ্গমস্থলে ঘন সবুজে ঘেরা চরখামের গ্রাম। নদীর তীর বরাবর বেড়িবাঁধ। তার গা ঘেঁষে গ্রাম। ঘন গাঢ় সবুজে ছাওয়া। ফলের গাছ, কাঠের গাছ। শাক-সবজি, মাছ। নদীর পাড় স্যাব দিয়ে বাঁধানো। তার ওপর গোবরের ঘুঁটে দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জ্বালানি। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে ছোট্ট একটা বাজার। সব দোকানই চালু। বিকেলে জেলেরা নদীর মাছ, যা পেয়েছে, নিয়ে এসে বসেছে। কেনার লোকেরও অভাব নেই। দ্রুতই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে তাজা মাছ। গ্রামের উত্তরের দিকটায় বিস্তীর্ণ ধানের জমি। চোখ জুড়ানো সোনালী ধান। কোথায়ও কাটা হচ্ছে। কোথায়ও কাটার অপেক্ষায়।
যেখানে সামান্য জায়গা, সেখানেই বুনে দেয়া হয়েছে গাছ। ফলে ঘন অরণ্যের মতো সবুজ গ্রাম। পতিত জমি নেই। শীতকাল। নদীর পানি কমছে। যেটুকু পাড় জাগছে, মানুষ সেখানেই বুনে দিচ্ছে কোনো সবজির বীজ। ক’দিনের মধ্যেই পলিমাটিতে গাছ ফনফনিয়ে উঠছে। এখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ভেদ নেই। দিনভর যে যাই করুক, সন্ধ্যায় সবাই এসে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। হাসি-ঠাট্টা হৈ-হুল্লোড় চলছে। এক আনন্দময় প্রাণবন্ত পরিবেশ।
এখানে নারীরাও স্বাস্থ্য সচেতন। তারা দল বেঁধে সকাল সন্ধ্যায় হাঁটছেন। সুস্থ থাকার জন্য। এতটা সচেতনতা আশা করিনি। কিন্তু এভাবেই দিকে দিকে বদলে যাচ্ছে গ্রাম্যজীবন। ঘাসের মধ্যে কেউ ফেলে দিয়েছিল কিছু বরবটির বীজ। জাংলা লাগেনি, কঞ্চি লাগেনি। ঘাসের মধ্যেই গজিয়ে আছে লালচে লম্বা লম্বা বরবটি। পথের পাশে। কিন্তু কেউ মালিকহীন ভেবে তুলে নিয়ে যাচ্ছে না।
সন্ধ্যায় বাজার বসে। শাক-সবজি, আলু, শিম, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি সকল পণ্য আছে বাজারে। হেঁটে দেখলাম গোটা এলাকা। ২০০২ সাল পরবর্তী অবস্থার ধারাবাহিকতায়ই এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ। সাধারণ মানুষের জয় এভাবেই নিশ্চিত হচ্ছে দেশজুড়ে। আশা হলো, মানুষই বদলে দেবে বাংলাদেশ, বদলে দিচ্ছে।
rezwansiddiqui@yahoo.com
মানুষ নিজের উদ্যোগে কিছু করার চেষ্টা করছে, সেখানেই থেমেছি। দেখেছি, আসলে মানুষ অবিরাম সৃষ্টিশীল ধারণা নিয়ে কাজ করছে। উৎপাদন বাড়াচ্ছে, আয় বাড়াচ্ছে, জীবনযাপনের মান বাড়াচ্ছে। সরকারের সাহায্য-সহযোগিতার ধার ধারছে না। একজন একটা লাভজনক উদ্যোগ নিলে আরো দশজন তাকে অনুসরণ করছে। ফলে কোনো কোনো এলাকার নাম হয়েছে নার্সারি গ্রাম। কোনো এলাকার নাম হয়েছে লতির গ্রাম। কোথাও একফসলি জমিতে ফলছে কেউড়া ফসল। উপজাতীয়রা পুষছে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল। আগে যেসব এলাকার নারীরা কৃষি জমিতে হাত লাগাতো না, তারাও মাঠে নেমে পড়েছে পুরুষের পাশাপাশি