ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
আর কত পাপ জমবে
প্রকাশ: ০২:১৯ এএম, ১৮ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০২:৪৮ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিক সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ নিয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবে পুলিশের অপরাধ দিনকে দিন বাড়ছেই। পুলিশের একটা শ্রেণি সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। চাঁদাবাজি, অপহরণ, ঘুষ গ্রহণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই সব অপরাধই তারা করছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এই দুর্বৃত্তদের হাতে বহু নিরীহ সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ ঘটনা প্রতিদিনই বাড়ছে। তাছাড়া বাহিনীর ভেতরে নারী সহকর্মীদের যৌন হয়রানির অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে দেদার। এছাড়াও আছে নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার গোলাম সাকলায়েন অভিনেত্রী পরীমনির সঙ্গে সকাল ৭টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত একান্তে সাকলায়েনের ফ্ল্যাটে সময় কাটিয়েছেন। এ ধরনের কর্মকান্ডকে জনাব ইসলাম পেশাদার অনৈতিকতা বলে অভিহিত করেছেন।
কিন্তু পুলিশের অন্য হাজারটা অপরাধের শাস্তি সাধারণত হয় সংশ্লিষ্ট কমিশনারকে বদলি করে, কিংবা সাময়িক বরখাস্ত করে। তারপর যে যার জায়গায় পুনর্বাসিত হয়ে যান। পুলিশে নতুন অপরাধের ঘটনা ঘটে। পুরানো অপরাধ ধূলিচাপা পড়ে যায়। সাকলায়েনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তাকে শুধু বদলি করা হয়েছে। আর রীতি মাফিক একটা তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে।
এর চারদিন পর পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর পুলিশ সুপার মোকতার হোসেনের বিরুদ্ধে তার অধীনস্থ একজন নারী ইন্সপেক্টর ধর্ষণের অভিযোগ আনেন। আর একটি ঘটনায় পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর খায়রুল আলমের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন এক যুবতী। তাকে অবশ্য জেলে পাঠানো হয়েছে।
এডিসি সাকলায়েনের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম। পরীমনির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। তিনি নাকি আরও সুন্দরী লাস্যময়ী নারীদের ব্ল্যাকমেইলিং সিন্ডিকেট চালাতেন। শিল্পপতি, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার কে নেই তার ক্লায়েন্টের তালিকায়। এই অভিযোগকে সত্য বলেই মনে হয়। কারণ ডিএমপি কমিশনার আগবাড়িয়ে সেসব ক্লায়েন্ট সম্পর্কে বলেছেন, পরীমনির সঙ্গে মিশতেন, এমন ব্যবসায়ীদের কোনো তালিকা হচ্ছে না। বা কাউকে গ্রেফতারের জন্য কাজ করছে না পুলিশ।
পরীমনি ইস্যুতে কোনো ব্যবসায়ীর সঙ্গে সম্পর্ক বা প্রতারণা করারও সুযোগ নেই। কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, পরীমনিকে নিয়ে কোনো পক্ষের কোনো অভিযোগ নেই। অতএব, কেইস ডিসমিসড। কিন্তু সাকলায়েনের বিরুদ্ধেও তো পরীমনি কোনো অভিযোগ করেননি। তবে সাকলায়েনকে লোকদেখানো বদলি কেন করা হলো?
পুলিশের দায়িত্ব এড়ানোর জন্য এখন এটা একটি ধরাবাঁধা গৎ যে, কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে দেখা যাবে। তার অর্থ দাঁড়ায়, যদি শফিকুল ইসলামের সামনেও কেউ খুন হন, এবং কেউ যদি অভিযোগ করার সাহস না পান, তবে মামলা হবে না, সে ঘটনার তদন্ত হবে না, দোষী ব্যক্তি শাস্তি পাবে না। এসব মনমানসিকতা পুলিশের বা সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়তে ভূমিকা রাখছে।
পুলিশ কমিশনারের ভাষ্য, সাকলায়েন আর পরীমনি উভয়েই প্রাপ্তবয়স্ক। তারা তো কথাবার্তা বলতেই পারেন, তাতে দোষ হবে কেন? তাই যদি হয়, তবে মামুনুল হকের ক্ষেত্রে এমন লঙ্কাকান্ড করা হলো কেন? না মামুনুল হক, না তার স্ত্রী কেউ তো কোনো অভিযোগ করেননি। বেড়াতে গিয়েছিলেন মাত্র। তাতে আপনাদের মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল কেন?
পুলিশের মধ্যে এসব ইতর অপরাধ কেমন করে ঘটছে, এ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, পুলিশের কেউ কোনো অপরাধে জড়িত হলে আমরা শাস্তির ব্যবস্থা করি। কেউ অপরাধ করে ছাড় পায় না।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পুলিশের উক্ত পর্যায় থেকে যথাযথ তদারকির অভাবে এবং এসব ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় পুলিশের কোনো কোনো সদস্য একেবারে বেপরোয়া হয়ে পড়েছেন। তারা ছোটখাটো অপরাধ শেষে বড় বড় অপরাধ করে চলেছে। সাবেক আইজিপি মোখলেসুর রহমান বলেছেন, পুলিশের ক্রমবর্ধমান অপরাধপ্রবণতায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করবে।
কারণ বিপদে-আপদে পুলিশের ওপরই ভরসা করতে হয়। তার মতে, পুলিশের হাইকমান্ড থেকে যথাযথ তদারকির অভাবেই এসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তার সদস্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। পৃথিবীর অনেক দেশেই বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু কঠোর নজরদারির ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা পুলিশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশেও পুলিশেরও এ ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া দরকার।
চাঁদাবাজি, ভুয়া মাদক মামলা, সঙ্গত কারণ ছাড়া কাউকে আটক করে রাখা, ঘুষ গ্রহণ, টাকার জন্য হত্যার হুমকি প্রভৃতি পুলিশের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অভিযোগ। পুলিশ সদর দফতরের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ লোক মনে করেন, পুলিশ বাহিনীর নারী সদস্যরা পুরুষ সদস্যদের হাতে হয়রানির শিকার হয়। তবে চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ ও ছিনতাইয়ের জন্য কতজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, পুলিশ সদর দফতরের বিবৃতিতে তা অবশ্য জানানো হয়নি। তবে এর আগে পুলিশ সদর দফতরের বিবৃতিতে বলা হয়ছে যে, ২০১৫ সালে ১০ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩,৫০৩ জনে। ২০১৭ সালে ১৪,৩৫৮ জন, ২০১৮ সালে ১৪,৩১৫ জন। যেসব অপরাধের জন্য বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও ঘুষ গ্রহণ।
সম্প্রতি সে রকম এক ঘটনা ঘটেছে দিনাজপুরে। মুক্তিপণের জন্য গত ২৪ আগস্ট রাতে এক মহিলা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে সিআইডির সহকারী পরিদর্শকসহ তিন পুলিশ সদস্য। তারা ঐ মহিলার আত্মীয়-স্বজনের মোবাইলে ফোন করে ১৫ লক্ষ টাকা দাবি করে। কিন্তু অপহৃতের পরিবার ৮ লক্ষ টাকা দিতে রাজি হয়। তারা দিনাজপুর শহরের নিকটবর্তী দশ মাইল এলাকায় যায় মুক্তিপণের টাকার জন্য। তখন স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।
অপহৃত জাহাঙ্গীর বলেছেন, দ্রুত মুক্তিপণের টাকার জন্য তারা যখন তার আত্মীয়দের ফোন করছিল, তখন ঐ অপহরণকারীরা তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালাতে থাকে। তিন সপ্তাহ আগে গোয়েন্দা বিভাগের ডিবি ওসিসহ ৬ সদস্যকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে আটক করা হয়। এরা একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২০টি স্বর্ণের বার ছিনিয়ে নিয়েছিল। আর একটি ঘটনা ঘটেছে ঢাকার রূপনগর থানায়। সেখানে একজন পুলিশের এসআই মৌসুমী গরু ব্যবসায়ীর কাজ থেকে আড়াই লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। ব্যবসায়ী রাশিদা বেগম বলেছেন, তাকে বলা হয় যে, তিনি যদি টাকা ফিরিয়ে চান বা এ ঘটনা কারও কাছে প্রকাশ করেন তবে তাকে ইয়াবা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হবে।
কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার পর পুলিশ ব্যাপকভাবে ভাবমূর্তির সঙ্কটে পড়ে। পুলিশ সদর দফতরে হায়দর আলী বলেছেন, অপরাধের সাথে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো আপস নয়। তাছাড়া কোনো কিছু গোপনও নেই। প্রত্যেকটা অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এসব ব্যবস্থা অন্যদের জন্য সতর্কবার্তাও বটে।
এরপর সামনে আসে গোপালগঞ্জের পুলিশ কর্মকর্তা বনানী থানার পরিদর্শক সোহেল রানা। অবৈধ পথে টাকা বানানোর জন্য সে খুলে বসে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘ই-অরেঞ্জ’। তার কাজই ছিল প্রতারণা। এই পথে সোহেল রানা ১১০০ কোটি টাকার মালিক হয়ে যায়। এক ভুক্তভোগী গ্রাহকের মামলায় ‘ই-অরেঞ্জ’র মালিকরা গ্রেফতার হন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সোহেল গ্রেফতার হননি। কিন্তু তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন, গ্রেফতার হতে পারেন যে কোনো সময়। নানা মহলে তদবির চালান সোহেল রানা। তাতে খুব একটা সাড়া না পেয়ে তিনি বিনা ভিসায় ভারত হয়ে নেপাল চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিধিবাম। তিনি চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্তে বিএসএফের হাতে আটক হন। ধারণা করা যায় ভারতের মাটিতে ভারতীয় আইন অনুযায়ীই তার বিচার হবে।
কিন্তু বিএনপির আমলে দুর্নীতি ও নানা অনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেয়ে। যেহেতু বিএনপি আমলে দুর্নীতির দায়ে চাকরি গেছে, অতএব তার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। সেই তত্ত্ব ধোপে টেকেনি।
তারপর গ্রেফতার হয়েছেন ডেমরা জোনের এসআই আকতারুজ্জামান। তিনি একটি ডাকাতদল পরিচালনা করেন। সাবাস। পুলিশকে এই ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ধারণা করি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে মনোযোগী হবেন।
লেখক : ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক