মাননীয় মন্ত্রী, আপনি কি একটি টেলিফোন সচল করতে পারেন?
প্রকাশ: ০২:৩৮ এএম, ১৯ জুন,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:১৫ এএম, ১৮ নভেম্বর,সোমবার,২০২৪
জনাব মোস্তফা জব্বার, মাননীয় টেলিফোন মন্ত্রী। গত ছয় মাস যাবৎ বড় বিপদে আছি। আমার টিএন্ডটি নম্বর ৮১৪৪০৭৫ খারাপ। আপনার লস্করদের পেছনে পেছনে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তারা এখন আর আমার ফোন ধরে না। একদিন কে ধরল। বলল, আমার লাইনম্যানরা তো বদলি হয়ে গেছে। আমরা দেখছি। সেই দেখায় ছয় মাস পার।
আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ১৯৭২ সাল থেকে। আপনি তখন গণকণ্ঠে চাকরি করেন। আমি নিয়মিত লিখি। তা ছাড়া আমরা দু’জনেই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলাম। দেখা-সাক্ষাৎ নিয়মিতই ছিল এই পরিচয় কখনো ম্লান হয়নি। বরং নানা কারণে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে।
আপনি যখন মন্ত্রী হলেন, তখন সব কিছু নিয়ে অশান্বিত হয়ে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম এবার টিএন্ডটির একটা গতি হবে। আপনি এসে ঘোষণা দিলেন ল্যান্ড ফোনের চার্জ হবে মাসিক একশত পঞ্চাশ টাকা। আর একশত পঞ্চাশ টাকার মধ্যেই টিএন্ডটি-টু-টিএন্ডটি যত খুশি ফোন করা যাবে। বলাবাহুল্য আমার টিএন্ডটি ফোনটা তখনও অচল ছিল। কেন অচল তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। অচল অবস্থায়ই এর বিল বাকী পড়তে থাকলো। মৃত ফোনের জন্য খুঁজে খুঁজে কেন বিল দিতে যাবো? মাঝে মাঝে বিভিন্ন স্থানে ফোন দেই ভাই আমার টেলিফোনটা সচল করে দিন। তারা দেখছি স্যার, দেখছি স্যার বলে। কি যে দেখে কে জানে?
এক সময় টিএন্ডটির জনসংযোগ পরিচালক ছিলেন আবদুল খালেক। সাংবাদিকরা তো বটেই তার বাইরেও বহু সংখ্যক মানুষ খালেক ভাইয়ের সেবা গ্রহণ করতেন। খালেক ভাই ফোন ধরতেন না, এ রকম অভিযোগ কেউ করতে পারবে না। শুধু বললেই হলো ফোনটি খারাপ। বলতেন আমি দেখছি। এক ঘণ্টার মধ্যে ফোন ঠিকঠাক। টেলিফোনের লোকেরা ফোন করে জানতে চাইতো, স্যার ফোনটা ঠিক হয়েছে। সেই সব সোনালী দিনের অবসান হয়েছে বহু আগেই। খালেক ভাইও নেই, তার ডিপার্টমেন্টের করিতকর্মা ভাবটাও নেই। ফোন সচল করার জন্য সংশ্লিষ্টদের ফোন করলে মনে হয়, এ দায়িত্বই তাদের না।
এখন কেউ বলতে পারেন হঠাৎ টিএন্ডটি ফোন নিয়ে পড়লেন কেন? টিএন্ডটি ফোন থাকলেই বা কি মোবাইলেই তো সব কাজ সারা যায়। সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু যখন কোনো অবস্থাতেই মোবাইলে রিচ করা যাওয়া না, নেটওয়ার্কে গোলমাল থাকে তখন টিএন্ডটি ছাড়া আর কোনো গতি থাকে না। সে কারণে এখনো বহু মানুষ বাসায় টিএন্ডটি ফোন রেখেছেন এবং মাঝে মধ্যে কথাবার্তাও বলেন।
আমার দফায় টিএন্ডটি’র মায়ায় প্রায় সাত-আট হাজার টাকা দন্ডী দিতে হলো। সেই ১৯৭৯ সালে ফোনটি নিয়েছি। এক ধরনের মায়াও পড়ে গেছে। এরপর ফোনটি চালু হলো। যথারীতি বিলও দিতে শুরু করলাম। মাস দুই সম্ভবত চালু ছিল। তারপর আবার হঠাৎ একদিন মরে গেলো টিএন্ডটি ফোন। এরে ওরে ফোন করি। পুরানো জবাব। শেষ পর্যন্ত একজন লাইনম্যান বললেন, আপনাদের ডিসের লাইনের সঙ্গে টিএন্ডটি লাইন মিলে গেছে। দুটো আলাদা তার মিলে যায় কীভাবে। কিন্তু লাইনম্যানের কথাই সত্য হতে হবে। তারপর থেকে আমার ৮১৪৪০৭৫ টিএন্ডটি ফোনটি মরে পড়ে আছে।
এখন আবার সেই একই হুজুত। টিএন্ডটি যদি ফোনটি ঠিক করতে রাজিও হয় তাহলে প্রথমে বলবে বিল ক্লিয়ার করেন। বিল ক্লিয়ারের পর তাদের দফতরে দৌড়াদৌড়ি। জুতা ক্ষয়, সময়ের অপচয়। টিএন্ডটির লোকবল তো প্রায় একই আছে। বড় ধরনের ছাঁটাই হয়েছে বলে শুনিনি। তাহলে তারা কেন কাজ করতে পারবে না। কেন বকেয়া পড়লে বিল তৈরি করে বাসায় পাঠাতে পারবে না। সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। অথচ বিশাল শ্বেতহস্তির মতো শ্রমিক বহর এখানে রয়েছে।
মাননীয় মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ে যোগ দেয়ার আগে আপনি অনেক চমকপ্রদ কাজ করেছেন। আপনি যখন সংবাদপত্রের কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই জগতে বিপ্লব সাধন করলেন, সেটা ছিল এক বিস্ময়। টেলিফোনে ছাপ। তারপর প্লেট তৈরি করে ডাইরেক্ট মেশিনে। কালিঝুলি নেই। কেরোসিনের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ নেই। কালিমাখা সাবানের টুকরা নেই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এক ছাপাখানা আপনি উদ্ভাবন করলেন।
দৈনিক বাংলায়ও তখন লাগলো প্রযুক্তি, কালিঝুলি কেরোসিন। আপনি আমাকে বললেন, রেজোয়ান তুমি একটু চেষ্টা করলেই আমি দৈনিক বাংলায় লাডলো প্রযুক্তি বদলে কম্পিউটার প্রযুক্তি চালু করতে পারি। লাডলো মেশিনগুলো অকেজো হবে বটে। আমি কম্পিউটার দেবো বাকিতে। কারো চাকরি যাবে না। সিফট বাই সিফট কম্পিউটার ট্রেনিং দিয়ে দেবো। আমি মহা খুশি। সম্পাদক আহমদ হুমায়ুনকে বুঝিয়ে বললাম। এই প্রযুক্তি সহজ, আসবেই। তিনি রাজি হয়ে গেলেন এবং দুই মাসের মধ্যে দৈনিক বাংলা পত্রিকা পুরোপুরি কম্পিউটারাইজ হয়ে গেল। আপনার প্রতি সে আমার এক অতিরিক্ত শ্রদ্ধা।
আপনি মন্ত্রী হওয়ার পর আপনার সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল। চ্যানেল আইতে স্মিত হাসি বিনিময় হয়েছিল। আপনাকে বলিনি কিছু। কিন্তু তখনও আমার টিএন্ডটি ফোনটি মৃতই ছিল। আজ হঠাৎ মনে হলো কোনো পদ্ধতিতেই তো পারলাম না, এবার আপনার শরণাপন্ন হয়ে দেখি। আমার রিডিং রুমের এক কোণে মৃত পড়ে থাকা ধূলিমলিন টেলিফোনটি সচল করা যায় কিনা। হ্যালো মন্ত্রী মহোদয় আমার ফোন নম্বর ৮১৪৪০৭৫।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
আবার সেই একই হুজুত। টিএন্ডটি যদি ফোনটি ঠিক করতে রাজিও হয় তাহলে প্রথমে বলবে বিল ক্লিয়ার করেন। বিল ক্লিয়ারের পর তাদের দফতরে দৌড়াদৌড়ি। জুতা ক্ষয়, সময়ের অপচয়। টিএন্ডটির লোকবল তো প্রায় একই আছে। বড় ধরনের ছাঁটাই হয়েছে বলে শুনিনি। তাহলে তারা কেন কাজ করতে পারবে না। কেন বকেয়া পড়লে বিল তৈরি করে বাসায় পাঠাতে পারবে না। সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। অথচ বিশাল শ্বেতহস্তির মতো শ্রমিক বহর এখানে রয়েছে