জবির নতুন ক্যাম্পাস
২শ একর জমিতে ৩শ একর রাস্তা, মিজানের লুটপাটের মহা পরিকল্পনা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:২০ এএম, ৫ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ০৫:৫২ এএম, ৬ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
★কাল্পনিক রাস্তায় ২৫০ কোটি!
★২০০ একর ক্যাম্পাসের ভেতর রাস্তা ৩৫৩ একর!
★পরিকল্পনা কমিশন বলছে অবাস্তব, পুনরায় প্রক্কলনের সুপারিশ!
ঢাকার কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় ২০০ একর জমিতে চলছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের কাজ। তবে ২০০ একর ক্যাম্পাসের ভেতর মোট ৩৫৩ একর পরিমাণ রাস্তা করার প্রস্তাব করা হয়েছে ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব), যা একেবারেই অবাস্তব। ক্যাম্পাসের আয়তন ছাড়িয়ে কাল্পনিক রাস্তা বানানোর এমন প্রস্তাব করে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের পরিকল্পনা করা হয়েছে। দুই বছর মেয়াদের এ প্রকল্পটির চতুর্থবার মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব মূল্যায়নকালে পরিকল্পনা কমিশনের নজরে আসে এসব অসংগতি।
তাদের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘প্রকল্প এলাকা হিসেবে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জে মোট ২০০ একর অর্থাৎ ৮,০৯,৩৭১ বর্গমিটার জমি অধিগ্রহণ করা হবে। অথচ প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য অভ্যন্তরীণ রাস্তার মোট আয়তন ১৪,৩১,৫৯৮ বর্গমিটার (৩৫৩ একর)। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ রাস্তার আয়তন মোট প্রকল্প এলাকার তুলনায় ১ দশমিক ৭৭ গুণেরও বেশি, যা বাস্তবে সম্ভব নয়। যথাযথভাবে পরীক্ষা করে পরিমাণ ও ব্যয় পুনরায় প্রাক্কলন করা প্রয়োজন।’ এদিকে জবির নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্পের ডিপিপি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেখানেও ২০০ একরের এই ক্যাম্পাসের ভেতরে ১৪,৩১,৫৯৮ বর্গমিটার অর্থাৎ ৩৫৩ একর অভ্যন্তরীণ রাস্তা তৈরির কথা বলা হয়েছে।
এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০২ কোটি ৭৬ লাখ ৫২ হাজার ৯৮১ টাকা। এতে প্রতি বর্গমিটারে গড় খরচ ২ হাজার ১১৪ টাকা ধরা হয়েছে। তবে প্রকৌশল দপ্তর বলছে, ডিপিপিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুপারিশকৃত ৩৩ শতাংশ বনভূমি, সুদীর্ঘ লেকের আয়তন, একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আবাসিক ভবনের জায়গা বাদে সংযোগ রাস্তার আয়তন ৩০ শতাংশের বেশি হবে না। অর্থাৎ ক্যাম্পাসের আয়তনের ৩০ শতাংশ রাস্তা ধরা হলে ২ লাখ ৪২ হাজার ৮১১ বর্গমিটারের খরচ- এস্টিমেট অনুযায়ী ৫১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ কাল্পনিক রাস্তা দেখিয়ে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিকল্পনা ডিপিপিতে দেখানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘ডিপিপিতে আয়তনের তুলনায় দেড় গুণের বেশি পরিমাণের যে অভ্যন্তরীণ রাস্তার কথা বলা হয়েছে সেটা অবাস্তব। ডিপিপি প্রণয়নের সময় আমি ছিলাম না। ডিপিপির এসব ভুলের জন্য আমরা কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই বিব্রত হচ্ছি ও নানা প্রশ্নেরও সম্মুখীন হচ্ছি। ওই সময় যিনি দায়িত্বে ছিলেন তিনি এর ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।
তবে ডিপিপি সংশোধন করার সুযোগ আছে।’ এদিকে ডিপিপিতে অভ্যন্তরীণ রাস্তার এস্টিমেটে দেখা যায়, সেই সময় প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী সুকুমার চন্দ্র সাহা, পরিকল্পনা উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দপ্তরের পরিচালক পদে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সাবেক রেজিস্টার প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামান (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী প্রধান আসমা নাসরীনের স্বাক্ষর।
এ বিষয়ে সুকুমার চন্দ্র সাহার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাক্ষর করা মানে ডিপিপি শুধু আমি একা করিনি। পুরো প্রকৌশল দপ্তর করেছে। আয়তনের তুলনায় রাস্তার পরিমাণ বেশি, এটা ভুল হয়েছে। ডিপিপি সংস্কার করা হলে রাস্তার আয়তন কমে আনুমানিক ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার মতো খরচ আসবে। ক্যাম্পাসের আয়তনের তুলনায় দেড় গুণের বেশি পরিমাণের এই অবাস্তব রাস্তা তৈরির পরকিল্পনা কার জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কিছুই না। সেই সময় আরবানা নামে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান থেকে যেভাবে এস্টিমেট তৈরি করে দেয়া হয়, সেটাই ডিডিপিতে দেয়া হয়েছে।
এদিকে জবির প্রকৌশল দপ্তরের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, ডিপিপি করার সময় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আরবানার সঙ্গে চুক্তি করা হয়নি। তৎকালীন উপাচার্য ড. মীজানুর রহমানের পছন্দের প্রতিষ্ঠান হিসেবে চুক্তি করার আগেই আরবানা দিয়ে দুই পুকুরে ২০টি ঘাট, ক্যাম্পাসের আয়তনের চেয়ে দেড় গুণের বেশি কাল্পনিক রাস্তা দেখিয়ে ২৫০ কোটি টাকার অতিরিক্ত বাজেটসহ নানা ‘আইটেমে’ বেশি বাজেট দেখিয়ে ডিপিপি তৈরি করা হয়। দুই বছর মেয়াদি এ প্রকল্প তার মেয়াদে শেষ হওয়ার কথা বলে লুটপাটের পথ তৈরি করেন তিনি।
ডিপিপিতে অস্বাভাবিক কাল্পনিক রাস্তার বিষয়ে নতুন ক্যাম্পাসের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) সৈয়দ আলী আহমদ বলেন, ‘তড়িঘড়ি করে ডিপিপি তৈরি করায় ভুল হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাইনি। পেলে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।’ এদিকে ডিপিপিতে ভুল হয়েছে বলা হলেও তা সংশোধন না করে ইতোমধ্যে দুই পুকুরে ২০টি ঘাটের জন্য ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকার টেন্ডার করা হয়েছে। সেটির কাজ চলছে। একইভাবে রাস্তা তৈরি করার জন্য ডিপিপি অনুসারে ৩০২ কোটি টাকার টেন্ডার আহ্বানের পরিকল্পনা চলছে। তবে পরিকল্পনা কমিশন থেকে এসব অসংগতি ধরা পড়ায় টনক নড়েছে সবার।
ডিপিপিতে শুধু পুকুর আর রাস্তার কাজেই অসংগতি নয়, পরিকল্পনা কমিশন নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্পের বিষয়ে আরো কিছু মতামত দিয়েছে। কমিশন বলছে, ‘অভ্যন্তরীণ রাস্তাসহ অনুরূপ অন্যান্য অঙ্গের (সীমানা প্রাচীর, ভূমি উন্নয়ন, পরিকল্পনা ও প্রকৌশল ভবন, সংযোগ সেতু, লেক, পুকুর) প্রাক্কলিত পরিমাণও প্রকল্প এলাকার মোট পরিমাপের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সীমানা প্রাচীর, পুকুর ঘাটসহ বিভিন্ন নির্মাণে অনুমোদিত ডিজাইন ও নকশা হতে বাস্তব কাজের অনেক ব্যত্যয় ঘটেছে।
বহিঃস্থ একটি কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটির (বুয়েট/গণপূর্ত) মাধ্যমে প্রকল্পের সম্পাদিত সব নির্মাণকাজের ব্যত্যয় চিহ্নিত করে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মানসম্মত উপকরণ ব্যবহার এবং স্পেসিফিকেশন ও ডিজাইন মোতাবেক নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে হবে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানসহ কারো কর্তব্য কাজে অবহেলা থাকলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকল্পের এক অঙ্গের অর্থ অন্য অঙ্গে ব্যয় করা যাবে না। অঙ্গভিত্তিক সংখ্যা বা পরিমাণ ও ব্যয়ে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে টিম গঠন করে প্রকল্পের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে হবে।’
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ট্রেজারার ও রুটিন দায়িত্বে থাকা উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাবিনা শারমীন বলেন, ‘২০০ একর ক্যাম্পাসের ভেতরে ৩৫৩ একর রাস্তা, এটা তো অবাস্তব একটি বিষয়। আমি ট্রেজারার হিসেবে নতুন জয়েন করেছি। বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা নেই। কাগজপত্র দেখে এবিষয়ে মন্তব্য করতে পারব।’
প্রকল্পের বর্তমান চিত্র : ২০১৬ সালের আগস্টে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তীব্র ‘হল আন্দোলনের’ মুখে নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণের ঘোষণা দেয় সরকার। ২০১৮ সালে ২০০ একরের নতুন ক্যাম্পাসের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার প্রাথমিক প্রকল্প পাস হয় একনেকে। প্রাথমিক প্রকল্পের আওতায় জমি অধিগ্রহণ, ভূমি উন্নয়ন, সীমানা প্রাচীর, মাস্টারপ্ল্যান তৈরি, লেক খনন, পুকুর খনন, ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা তৈরি, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থার কথা বলা হয়। দুই বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল।
তবে ৬ বছরে তিনবার মেয়াদ বাড়ালেও এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৫৫ শতাংশ। ২০০ একরের মধ্যে এখনো ১২ একর জমি বুঝে পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া সীমানা চিহ্নিত না হওয়ায় আটকে আছে প্রাচীরের কাজ। লেক, পুকুর খনন শেষে বর্তমানে মাটি ভরাট, ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন নির্মাণ ও পুকুরের ঘাট নির্মাণের কাজ চলছে। কাজ শেষ না করতে পারায় প্রতি বছরই বাজেট ফেরত যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১৭৪ কোটি টাকা প্রকল্পের বাজেট পেলেও খরচ করতে না পারায় ৯৩ কোটি টাকা ফেরত গেছে।
দিনকাল/এসএস