ভয়-ভীতি গ্রেফতার ও টানটান উত্তেজনা নানা উদ্বেগের মধ্যে কাল চসিক নির্বাচন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৪১ এএম, ২৭ জানুয়ারী,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০১:৫০ এএম, ২৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
হামলা-মামলা ভয়-ভীতি গ্রেফতার ও টানটান উত্তেজনা নানা উদ্বেগের মধ্যে কাল বুধবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল আলোচিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে ভোটগ্রহণ।
আওয়ামী লীগের হামলা নির্যাতনের তোয়াক্কা না করে গত ২১ দিন মোটামুটি উৎসবমুখর পরিবেশে প্রচারণা করলেও শেষে এসে পুলিশের অ্যাকশনে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িছাড়া করা হয়। ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্যে কাল নির্বাচন কেমন হবে এনিয়ে চট্টগ্রামের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেন। সাধারণ মানুষ মনে করেন এমন নির্বাচনের কোনো প্রয়োজন নেই। নির্বাচন মানেই একটা উৎসব। দেশের ঐতিহ্য এই নির্বাচনে এসব এখন আর নেই। নির্বাচনের সময় রাত দিন চায়ের দোকানে বসে আড্ডা আলোচনা এখন আর দেখা যায় না। এখন নির্বাচন মানে আতঙ্ক হামলা মামলা গ্রেফতারের ভয়। এক সময় নির্বাচনের আগের রাতে বলা হতো চাঁদ রাত। কিন্তু এসবের কিছুই নেই এখন নির্বাচনে আমেজে।
সোমবার নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিন ছিল। নগরীর ৪১ টি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এবং কাউন্সিলর প্রার্থীরা রাত ১২ টা পর্যন্ত মিছিল-সমাবেশ করে উৎসবের আমেজ নিয়ে। অধিকাংশ সড়কে যান চলাচল বন্ধ। কিন্তু উল্টো চিত্র দেখা যায় বিএনপি মেয়র ও কাউন্সিলরদের বেলায়। সন্ধ্যা সাতটার পর নীরব হয়ে যায় বিএনপি এসব প্রার্থীদের বাড়ি ঘর, দলীয় অফিস। বিশেষ করে নাসিমন ভবন বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে নেমে আসে নিরব নিস্তব্ধ। বিকাল থেকে নাসিমন ভবন দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে ডিভি পুলিশ যাকে পেয়েছে তাকে গ্রেফতার করেছে। এঘটনার পর সন্ধ্যা থেকে কার্যালয় ফাঁকা হয়ে যায়। ছিল না কাক পক্ষীও। এক দিকে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী কাউন্সিলর উৎসবের আমেজ ।
ভোটগ্রহণ সামনে রেখে শেষ মুহূর্তে পুলিশের বিরুদ্ধে নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতারের অভিযোগ করেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেছেন, পুলিশ ঘরে ঘরে গিয়ে অভিযান চালানোর কারণে সম্ভাব্য পোলিং এজেন্টরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি আজ মঙ্গলবার দুপুরে নির্বাচন অফিসে গিয়ে নেতা কর্মীদের ছেড়ে দিতে বলেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন ১৫ থানায় মামলায় অন্তত এক হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। রাতভর পুলিশ সাদা পোশাকে মাইক্রোবাস নিয়ে নেতাকর্মীদের বাসায়-বাসায় তল্লাশির নামে তান্ডব চালিয়েছে। ভোট কেন্দ্রে না যেতে পরিবারকে হুমকি দিয়ে আসছে। গত রাতে আমাদের ৫৬ জন নির্বাচনী এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নেতা কর্মীদের সাথে নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা কেউ মমলার আসামি নয়। আইনের পোশাক পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তা বেআইনি কাজ করছে।
ড. শাহাদাত হোসেন বলেন, বর্তমানে ভোটের পরিবেশ অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে তারা আদৌ ভোট দিতে পারবে কি না। নির্বাচনকে বানচালের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আমি পরিষ্কার বলে দিতে চাই, নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে জনরায় মানতে বিএনপি প্রস্তুত। ভোটের মাধ্যমে যে রায়ই আসুক বিএনপি স্বাগত জানাবে। তিনি প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর উদ্দেশে বলেন, বিএনপির পক্ষে গণসমর্থন-গণজোয়ার দেখে ভীত হয়ে ভোট কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করলে, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে জনরায় পাল্টানোর চেষ্টা করলে চট্টগ্রামের জনগণ মেনে নেবে না। চট্টগ্রামবাসী আওয়ামী লীগের এ অগণতান্ত্রিক আচরণের কঠোর জবাব দেবে।
তিনি বলেন, গত ১২ বছরে আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সুষ্ঠু নির্বাচন করার ইতিহাস নেই। তারা আরেকটি ভোট চুরির ইতিহাস রচনা করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষকে ভোট কেন্দ্রে আসতে বাধা দেয়ার পরিকল্পনা করে রেখেছে অওয়ামী লীগের ক্যাডারেরা।
এ নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থী বাদে আরও চারটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী নির্বাচন করছেন। এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা ও উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেছেন, পরিবেশ সুষ্ঠু না হলে অবাধ, নিরপেক্ষ, আইনানুগ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। সোমবার ঢাকায় নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
নির্বাচন প্রচারের পর থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের অনুসারীদের মধ্যেও ঘটেছে খুনোখুনির ঘটনাও। নির্বাচনি সহিংসতায় এরই মধ্যে তিনজন খুন হয়েছেন।
সর্বশেষ রবিবার আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউলের পক্ষে যুবলীগের প্রচারণায় অভ্যন্তরীণ বিরোধে ছুরিকাহত হয়েছেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে সোমবার মধ্যরাতে শেষ হয়েছে আনুষ্ঠানিক প্রচার। মাঠে নেমেছেন পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সদস্যরাও।
এবারের নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী রয়েছেন ৭ জন। প্রধান দুই মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের এম রেজাউল করিম চৌধুরী ও বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেন নিজেদের জয়ের ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এছাড়া ২২৫ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর সকলেই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। এর মাঝে দুই দলে ৩২ জন বিদ্রোহী প্রার্থীও রয়েছেন।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৭৩৫টি কেন্দ্রে ভোটার প্রায় সাড়ে ১৯ লাখ। তবে একজন প্রার্থী মারা যাওয়ায় নগরীর ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর পদে কাল ভোটগ্রহণ হবে না। তবে ওই ওয়ার্ডে মেয়র ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ভোট নেয়া হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই ভোটগ্রহণকে ভোটোৎসবে পরিণত করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। অধিকাংশ কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ। এ নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন নগরবাসী। এ ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের আশঙ্কা নাকচ করে দিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাল সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বছরের ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে দলীয় মনোনয়ন পর্যন্ত সবই সম্পন্ন হয়েছিল। নির্বাচনের মাত্র দিনকয়েক আগে করোনা পরিস্থিতিতে স্থগিত করা হয় নির্বাচন। পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হওয়ার পর নতুন করে ভোটগ্রহণের দিন নির্ধারণ করা হয় এ বছরের ২৭ জানুয়ারি। নতুন তারিখ ঘোষণার পর গত ৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা। এর মধ্যে হামলা পাল্টা হামলা হয়েছে। অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগও কম নয়। এসবের মধ্যেও জমজমাট নির্বাচনী প্রচারণা দেখা গেছে। প্রার্থী ও সমর্থকদের গণসংযোগ ও শ্লোগানে মুখর থেকেছে নগরী। এখন দেখবে সারা দেশের মানুষ কেমন নির্বাচন হয় চট্টগ্রামে।
এ দিকে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও চসিক নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ হবে। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট নেয়া হবে। প্রতিটি কেন্দ্রেই ইভিএমে ভোটগ্রহণ চলবে। তিনি বলেন, নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার জন্য পর্যাপ্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে নেমেছে। তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ৭৩৫টি ভোট কেন্দ্রে ৪ হাজার ৮৮৬টি বুথে ভোটগ্রহণ করা হবে। এর মধ্যে অস্থায়ী ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ২টি, অস্থায়ী বুথের সংখ্যা ৭৬৪টি। ৭৩৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৪১৭টি বা ৫৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রশাসন। ভোটগ্রহণের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৭৩৫ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ৪ হাজার ৮৮৬ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং ৯ হাজার ৭৭২ জন পোলিং কর্মকর্তা।
ভোটগ্রহণের দিন চট্টগ্রামে ভোটোৎসব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে হাসানুজ্জামান বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে সকল ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। তিনি সকলকে দায়িত্বশীল আচরণ করার আহŸান জানিয়ে বলেন, সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হবে।