চসিক নির্বাচনে ৫৬ অভিযোগ, ‘অনুরোধেই’ দায় সারছে ইসি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৫৬ এএম, ২৫ জানুয়ারী,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০২:৩৯ এএম, ২৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর পর আচরণবিধি ভঙ্গ, হামলা-হুমকিসহ ৫৬টি অভিযোগ জমা হয়েছে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত। পণ্য পরিবহনকারী বিশাল ট্রেইলার গাড়িকে মঞ্চ বানিয়ে আগে-পিছে মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যান নিয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীর সমর্থনে প্রচারণা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। প্রচারণায় অংশ নেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। শনিবার (২৩ জানুয়ারি) নগরের লালখান বাজারের ইস্পাহানি মোড় থেকে শুরু হওয়া এ প্রচারণার গাড়িবহর নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে। তাদের গাড়িবহরের কারণে যানজট সৃষ্টি হওয়ায় সাধারণ মানুষকে পড়তে হয় ভোগান্তিতে।
এর আগে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের ডেকে মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীর জন্য নগরবাসীর কাছে ভোট চেয়েছেন সরকারি পদে থাকা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। এমনকি কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হওয়ার কথা থাকলেও একটি দলের পক্ষ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিজেদের কাউন্সিলর প্রার্থীদের নাম ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এর বাইরেও মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের অভিযোগের পাহাড় জমছে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে।
কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশন এসব অভিযোগের ‘সত্যতা’ পাচ্ছে না অথবা ঘটনাগুলোতে নির্বাচন কমিশন তাদের করণীয় ঠিক করতে পারছে না।
আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর পর আচরণবিধি ভঙ্গ, হামলা হুমকিসহ শনিবার পর্যন্ত ৫৬টি অভিযোগ জমা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক ১২টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে তিনটি অভিযোগ। বাকি ৪১টি অভিযোগ নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীদের। এর মধ্যে বিএনপি প্রার্থীর ১২টি অভিযোগের তিনটির কোনো সত্যতা পায়নি নির্বাচন কমিশন ও তদন্তকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আটটি অভিযোগের কোনো ফলাফল জানাতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। শুধু একটি অভিযোগের ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের নির্বাচনি বিধিমালা মেনে চলার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে কমিশন। ২০ জানুয়ারি মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদত হোসেনের পক্ষে চট্টগ্রাম নাগরিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক একরামুল করিম অভিযোগ করেন, ‘আওয়ামী লীগের (প্রেসিডিয়াম মেম্বার) সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের স্বাক্ষরে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দল সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের তালিকা ছাপানো হয়েছে, যা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বিধিমালার লঙ্ঘন।’
নির্বাচন কমিশন এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নির্বাচনি কাজে ব্যবহার না করার অনুরোধ জানিয়েই দায় সেরেছে। এর আগে নির্বাচনি প্রচারের প্রথম দিন (৮ জানুয়ারি) আচরণবিধি লঙ্ঘন করে দক্ষিণ পাহাড়তলীতে গাড়িবহর নিয়ে প্রচারণা চালান আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী। এ সময় তিনি ব্যস্ততম সড়ক বন্ধ করে পথসভা। ছবিসহ এ খবর ছাপা হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। পরে ১২ জানুয়ারি এ নিয়ে অভিযোগ দেয় বিএনপি। ইসি বলছে, তদন্ত করে এ ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি। পাহাড়তলী ও আকবর শাহ থানা পুলিশকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হলেও দুই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানান, যানজটের কারণে রেজাউল করিম চৌধুরীর পেছনের গাড়িগুলোকে তার বহরের গাড়ি মনে হয়েছে। গত ২২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এস রহমান হলে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে মতবিনিময় সভায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীর জন্য নগরবাসীর কাছে প্রকাশ্যে ভোট প্রার্থনা করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। তিনি ‘বিষয়টি অন্যায় হলে’ মাফ করে দেয়ারও আহ্বান জানান।
সেদিন এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচনি আচরণবিধি অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের মেয়র কারও পক্ষে ভোট চাইতে পারেন না। প্রশাসকের বিষয়ে বিধিতে কী বলা আছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। যদি বিধি অনুযায়ী তিনি ভোট চাইতে না পারেন তাহলে তাকে এ বিষয়ে নিষেধ করা হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে নৌকায় ভোট চেয়েছেন চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, যা নির্বাচনি আচরণবিধির লঙ্ঘন বলে অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ শনিবার (২৩ জানুয়ারি) ট্রেইলার গাড়ি, মোটরসাইকেলযোগে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরীর পক্ষে ভোট চেয়ে প্রচারণা চালায় ছাত্রলীগ। প্রচারণায় অংশ নেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। যদিও নির্বাচনি আচরণবিধি অনুযায়ী প্রচারণায় গাড়িবহর ও শোডাউন নিষিদ্ধ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এদিন বিকেলে বিশাল একটি খোলা ট্রেইলার ডেকোরেশনের কাপড় দিয়ে সাজিয়ে বানানো হয় ভ্রাম্যমাণ মঞ্চ। এর সামনে ছিল অন্তত শ’খানেক মোটরসাইকেল। পেছনে ছিল আরও ২৫টি পিকআপ ভ্যান। এর পেছনে আরও কিছু মোটরসাইকেল। ধীরগতিতে চলা গাড়িবহরের সঙ্গে হেঁটে অংশ নেন ছাত্রলীগের কয়েকশ নেতাকর্মী। ট্রেইলারে ছিলেন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতারা। এই গাড়িবহরের কারণে যানজট সৃষ্টি হয়, ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকেও। এ বিষয়ে জানতে গতকাল রবিবার সকালে রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ কারণে আপনি আমাকে মিটিংয়ের মাঝখানে ফোন করেছেন?’ পরে মিটিংয়ে আছি বলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এদিকে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কাউন্সিলর প্রার্থীরাও। মেয়র প্রার্থীর মতো কাউন্সিলরদের অভিযোগেরও দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তারা। গতকাল পর্যন্ত কাউন্সিলর প্রার্থীরা মোট ৪১টি অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন ১৩টি ঘটনার কোনো ফলাফল জানাতে পারেনি। কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে দুই প্রার্থীকে। আওয়ামী লীগের দুই বিদ্রোহী প্রার্থীকে ডেকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত এক কাউন্সিলর প্রার্থীকে করা হয়েছে সতর্ক।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক নারী প্রার্থীর পোস্টার পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় তিন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ১৮ জানুয়ারি নগরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদনগর এলাকায় সরকারি দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থক ও কর্মীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর নারীকর্মীদের লাঞ্ছনা করার অভিযোগ ওঠে। পরে এ ঘটনায় ১৯ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেন বিদ্রোহী প্রার্থী মো. এয়াকুব। এ ঘটনায় পাঁচলাইশ থানার ওসিকে তদন্তের নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু ঘটনাস্থল মোহাম্মদনগর নগরের বায়েজিদ বোস্তামি থানার আওতাভুক্ত এলাকা। কাউন্সিলর প্রার্থী মো. এয়াকুবের অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন অভিযোগের বিষয়টি যাচাই না করেই অন্য থানাকে দায়িত্ব দিয়ে দায় সেরেছে।
একই ঘটনা ঘটেছে এর আগে ১২ জানুয়ারি দায়ের করা একটি অভিযোগের ক্ষেত্রেও। ২৮ নং পাঠানটুলি ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল কাদের তার নির্বাচনি এলাকা মতিয়ারপুল থেকে কদমতলী পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুরের সমর্থকদের বিরুদ্ধে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা ও গণসংযোগে বাধা দেয়ার অভিযোগ করেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয় সদরঘাট থানাকে। পরে প্রতিবেদনে জানানো হয়, ঘটনাস্থল ডবলমুরিং থানায় হওয়ায় ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। অথচ পোস্টার ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে সেদিন রাতেই ২৮ নম্বর পাঠানটুলি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর এবং বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদেরের সমর্থকদের সংঘর্ষে আজগর আলী বাবুল (৫৫) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীর মৃত্যু হয়।
নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেন, যদি কোনো ফৌজদারি কর্মকান্ড হয়ে থাকে, তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এই সুযোগে কেউ যেন হয়রানি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখছি। পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে হয়রানি করছে, বিএনপির এ অভিযোগ প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ‘এই অভিযোগ সঠিক নয়। পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে হয়রানি করছে এমন কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। নির্বাচন পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত যা আছে তা নিয়ে আমরা খুবই আশাবাদী। তবে সনাক ও টিআইবি চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের অনেক ক্ষমতা দিয়েছে সংবিধান। তারপরও নির্বাচন কমিশন যেভাবে ভূমিকা রাখার কথা সেভাবে রাখতে পারছে না। এসব কারণে ক্ষমতাসীন কোনো কোনো প্রার্থী নির্বাচনে অবৈধ সুযোগ নিচ্ছেন। সুশাসনের ঘাটতি থাকার কারণে নির্বাচন কমিশনের শক্তিশালী ভূমিকা অনুপস্থিত।