খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অতি সংকটে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৪৫ এএম, ২২ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০১:২০ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অতি সংকটে। তাঁর শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। কারণ তাঁর শারীরিক প্যারামিটারগুলো ওঠা-নামা করছে। ‘লিভার সিরোসিসে’ আক্রান্ত বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল দেশে নেই। তাঁর চিকিৎসা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি ছাড়া সম্ভব হবে না। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর জন্য বারবার দাবি করা সত্ত্বেও সরকার রহস্যজনকভাবে নীরব থাকছে। বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসায় আইনি কোনো জটিলতা নাই।
এদিকে লিভার সিরোসিসের কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ব্লেডিং হচ্ছে জানিয়ে তাঁর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানির বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার সুপারিশ করেছেন। তারা জানিয়েছেন, বিএনপি নেত্রীর যকৃত বা লিভারে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। একবার এই রক্তক্ষরণ সামাল দেয়া গেছে। তবে এখন তাঁর যে অবস্থা, সেটি দ্বিতীয়বার সামাল দেয়া কঠিন হবে। বাংলাদেশে দু-তিনবার রক্তক্ষরণ সামাল দেয়ার কারিগরি সুযোগ নেই দাবি করে যত দ্রুত সম্ভব তাঁকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তারা। এর আগে ২৮ নভেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসভবন ফিরোজায় বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা তাঁর সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে ব্রিফ করেন। সংবাদ সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়ার রোগ নিয়ে প্রাথমিক একটি বর্ণনা দেন ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির গঠন করা মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ফখরুল মোহাম্মদ সিদ্দিকী (এফ এম সিদ্দিকী)। ‘বেগম খালেদা জিয়ার পেট থেকে চাকা চাকা রক্ত যাচ্ছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইউনাইটেড হাসপাতালে একবার রক্ত দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের রোগীকে বারবার রক্ত দেয়া সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, আশঙ্কা করছি, আবার যদি ব্লেডিং হয় তাহলে এটা কন্ট্রোল করা সম্ভব হবে না। ব্লেডিং হলে মৃত্যুঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে। অধ্যাপক এফএম সিদ্দিকী বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার শরীর ২৩ নভেম্বর থেকে আবার অবনতি হয়। ব্লাড প্রেশার ও হিমোগ্লোবিন কমে যায়। টয়লেটের সাথে কালো স্টুল যায়। পুরো ক্লোন রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে গেছে। পুরো ক্লোন রক্তে জমাট হয়েছে। দুইদিন খুবই রক্তক্ষরণ হয়েছে। ২৪ নভেম্বর রাতে তাঁকে আবার জেনারেল ওটিতে নেয়া হয়। যাতে সিরিয়াস কিছু হলে তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নেয়া যায়।
তিনি আরো বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থা হচ্ছে- যদি জীবন বাঁচাতে চান তবে রক্ত সঞ্চালনের বাইপাস করতে হবে। এই টেকনোলোজিটা বাংলাদেশে তো নেই বরং আশেপাশের সিঙ্গাপুর বা ব্যাংককেও নেই। এটা দুই একটা সেন্টারে হয়ে থাকে যেটা আমেরিকা বা জার্মানিতে আছে।
এফএম সিদ্দিকী বলেন, রক্তক্ষরণে বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। কারণ রক্তক্ষরণ বন্ধের প্রযুক্তি আমাদের দেশে নেই। ওনার তিনবার ইতিমধ্যে রক্তক্ষরণ হয়েছে। আবারো রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এরইমধ্যে তাঁকে অ্যাডভান্স সেন্টারে না পাঠালে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। যত দ্রুত সম্ভব তাঁকে বিদেশে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে শিফট করাও মুশকিল হয়ে যাবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয়। ‘লিভার সিরোসিসে’ আক্রান্ত বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য মানসম্মত হাসপাতাল দেশে নেই। তাঁর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। লিভার সিরোসিস অত্যন্ত মারাত্মক রোগ। এদেশে তাঁর যথাযথ চিকিৎসা নাই। এটা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে হয়। তাঁর যদি আবার রক্তক্ষরণ হয় তবে তিনি বাঁচবেন না। তাই আমাদের দাবি, তাঁকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হোক। এটা কোনো দয়ামায়া, মহানুভবতা বা মানবিক ব্যাপার নয়। এটা তাঁর নাগরিক অধিকার। বিদেশে চিকিৎসায় আইনি কোনো জটিলতা নাই।
তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন জামিন প্রাপ্য হলেও তিন বছর ধরে কারাগারে আছেন। এ সময় তাঁর কোনো চিকিৎসা হয়নি। সরকার তাঁকে বিদেশে চিকিৎসা করাতে দিচ্ছে না। আজকে যদি বেগম খালেদা জিয়াকে সরকার বিদেশে না পাঠায়, যদি আমরা গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে না পারি তাহলে এ দেশের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের বর্তমানে দুটি বড় সমস্যা রয়েছে। একটি হচ্ছে, তাঁর রক্তক্ষরণ হয়ে হিমোগ্লোবিন কমে যায় এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অন্যদিকে আর্থ্রাইটিস, কিডনি, ফুসফুস, চোখের সমস্যা আছেই। বর্তমানে ওষুধ দিয়ে তাঁর রক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। তারপরও মাঝে মধ্যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, ম্যাডামের অবস্থা আগের মতোই আছে। তিনি এখনও সিসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। কোনো উন্নতি নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওষুধ দিয়ে ম্যাডামের রক্তক্ষরণ বন্ধ রাখা হয়েছে। তারপরও মাঝে মধ্যে ওনার রক্তক্ষরণ হয়। আবার ওষুধ দিয়ে বন্ধ করতে হয়। হিমোগ্লোবিনও মাঝে মধ্যে কমে যায়।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশের তিনবারের সাবেক সফল প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে জীবনের এক চরম সঙ্কটময় মুহূর্ত পার করছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর জন্য বারবার দাবি করা সত্ত্বেও সরকার রহস্যজনকভাবে নীরব থাকছে। এছাড়াও বেগম খালেদা জিয়া শারীরিক নানা সমস্যা নিয়ে চলতি বছরের ১৩ নভেম্বর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ এবং লিভার সিরোসিসের কথা জানিয়েছেন তাঁর চিকিৎসকবৃন্দ। এই চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয়, তাঁকে বাঁচাতে হলে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা জরুরি প্রয়োজন। যতই দিন যাচ্ছে তাঁর শারীরিক অবস্থার ততই অবনতি ঘটছে।
তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের প্রতীক’ বেগম খালেদা জিয়ার মুমূর্ষু অবস্থাকে কোনভাবেই বিবেচনায় না নিয়ে সরকার এক ভয়ানক মনুষ্যত্বহীন চক্রান্তে মেতে উঠেছে। তাঁকে পৃথিবী থেকে বিদায় করার জন্যই তাঁর চিকিৎসা নিয়ে সরকার নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। অথচ বেগম খালেদা জিয়ার মতো সংগ্রামশীল জীবন এখনও কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। এদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ইতিহাসে এক সমুজ্জ্বল নাম খালেদা জিয়া। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে তিনি যে রাজনৈতিক তরঙ্গ তৈরি করেছিলেন তা আজও গণতন্ত্রহারা মানুষকে আন্দোলিত করে। বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষমতা জনগণ থেকে উৎসারিত, ষড়যন্ত্রের কোনো অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে নয়।
সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, জনগণের এই মহিয়সী নেত্রী এখন নির্যাতিত, নিপীড়িত, চিকিৎসাহীনতায় মমূর্ষু। এই দৃষ্টান্তও পৃথিবীতে বিরল। বেগম খালেদা জিয়া বন্দি জীবন-যাপন করছেন দেশেরই এক গণতন্ত্র ও সভ্যতা বিরোধী শক্তির মাস্টারপ্ল্যানের দ্বারা। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বেগম খালেদা জিয়া বঞ্চিত হচ্ছেন মৌলিক মানবাধিকার থেকে। দেশের প্রচলিত আইনে দেশনেত্রীর বিদেশে চিকিৎসা সম্ভব। দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবিকেও অগ্রাহ্য করে সরকার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিঃশেষ করে দেয়ার আয়োজনে ব্যস্ত। তবে আমরা দৃঢ়কন্ঠে বলতে চাই-দীর্ঘ রাজনৈতি জীবনে জনগণের সর্বোচ্চ ভালবাসা অর্জন করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। এই আবেগমন্ডিত ভালবাসার শক্তিকে বিকারগ্রস্ত অগণতান্ত্রিক দানবীয় শক্তি কখনোই পরাজিত করতে পারবে না। যে ঝুঁকি ও সাহস নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া জনগণের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই করেছেন তাকে ধ্বংস করা যাবে না।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, আমরা আবারো জোরালো কন্ঠে বলতে চাই-এই মুহূর্তে উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
চিকিৎসকদের বাইরে বেগম খালেদা জিয়ার খোঁজখবর রাখতে নিয়মিত হাসপাতালে আসা-যাওয়া করছেন পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান সিঁথি। এর বাইরে প্রায় প্রতিদিনই তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত ১৩ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এভারকেয়ারের চিকিৎসক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১০ জনের একটি বিশেষ মেডিকেল টিম ৭৭ বছর বয়সী সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন।