স্ক্যানিংয়ে ধরা পড়ে না অনেক মাদক, বিমানবন্দরে বসছে ডগ স্কোয়াড
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:১৮ এএম, ২৪ মে,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:৫৭ পিএম, ৮ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৯ বছর পর গত ২২ মার্চ সপরিবারে দেশে আসেন মোহাম্মদ রায়হান। দেশে ফেরার সময় ব্যাগের ভেতর একটি নোটবুকে অভিনব কায়দায় লুকিয়ে আনেন বিপুল পরিমাণ মাদক লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড (এলএসডি)। ওইদিন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর স্ক্যানিংয়ে ভয়ংকর মাদকের এ চালান ধরা পড়েনি। পরে ডিজিটাল পদ্ধতিতে তিনি গ্রাহকদের কাছে এলএসডি বিক্রি শুরু করেন। একসময় ক্রেতা সেজে এলএসডি কিনতে গিয়ে র্যাব গ্রেফতার করে রায়হানকে। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই মাদক জব্দ করে। এরপর কয়েকটি চালান জব্দ করে পুলিশ-র্যাব। এর সবই বিমানবন্দর দিয়ে দেশে ঢুকেছে। অথচ বিমানবন্দরের অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে স্ক্যানিংয়ে ধরা পড়ছে না ভয়ংকর এই মাদক। এ সুযোগে মাদক কারবারি চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অবাধেই তারা নিয়ে আসছে এলএসডি। বিক্রি করছে অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে, যা দুশ্চিন্তায় ফেলেছে মাদক উদ্ধারকারী সংস্থাগুলোকে।
পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, শাহজালাল বিমানবন্দর মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, এমন তথ্য তারা পাচ্ছেন। এর জন্য মূলত দায়ী লাগেজে পণ্য পরিবহনের সময় স্ক্যানিং ঠিকমতো না হওয়া। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছিল, বিমানবন্দরে শুধু স্ক্যানার দিয়ে মাদক ঠেকানো যাচ্ছে না। পার্শ্ববর্তী দেশের অনেক বিমানবন্দরে ডগ স্কোয়াড ব্যবহার হয়। বাংলাদেশে তা নেই। ওই দেশগুলো তাদের বিমানবন্দরে ডগ স্কোয়াড দিয়ে অনেক মাদক উদ্ধার করে। ডগ স্কোয়াড সংযোজিত হলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়বে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর শাহ্জালালে ইয়াবার দুটি চালান জব্দ করা হয়। চালান দুটি মধ্যপ্রাচ্যগামী দুটি ফ্লাইটে ঢাকা বিমানবন্দরে আসে। বিশেষ করে চোরাকারবারিরা কুরিয়ার সার্ভিসের পার্সেল বেশি ব্যবহার করে। ওই পার্সেলের বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে তারা নিয়ে আসছে বিভিন্ন ধরনের মাদক। ডগ স্কোয়াড দিয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি করলে পার্সেলে আসা মাদক ঠেকানো যাবে।
সূত্র জানায়, ডিএনসির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে র্যাব, বিজিবিসহ যেসব সংস্থার ডগ স্কোয়াড রয়েছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। সেগুলোকে কীভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিছু তথ্য তারা পেয়েছে। সেগুলোকে তারা কাজে লাগাবে। ডগ স্কোয়াড সংযোজন হলে মাদক উদ্ধারে ডিএনসি বড় কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ডগ স্কোয়াড স্ক্যানারের পাশে এবং যেখান থেকে পণ্য খালাস হয় সেখানে ব্যবহার করা হবে। ওই সময় ডগ স্কোয়াড অবৈধ পণ্যের সংকেত চিহ্ন পেলে উদ্ধারকারীরা দ্রুত মাদক উদ্ধার করতে সক্ষম হবে। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের ‘আত্মহত্যা’র কারণ খুঁজতে তদন্তে নামে গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্তের মধ্যে রাজধানীর একটি বাসা থেকে এলএসডি জব্দ করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগ। মূলত ওই মৃত্যু তদন্তেই এলএসডির বিষয়টি সামনে আসে।
পুলিশ বলছে, এলএসডি সেবনকারীদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। তাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. একরামুল কবির বলেন, খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এক বছর আগে থেকেই এলএসডির ব্যবসা চলছে। যে কোনো একটি মাদক ব্যবসায়ী চক্র শিক্ষার্থীদের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়ে তাদের দিয়ে এই ব্যবসা চালাচ্ছে। যেহেতু মাদকটি বাইরের দেশ থেকে আসছে, সেহেতু অবশ্যই এই চক্রের গডফাদার রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছোট স্টিকারের মতো স্ট্রিপ, ব্লটার পেপারে বা নকশা করা কাগজে থাকে মাদক এলএসডি- যা ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে। বেশিরভাগ সময়ে আনা হচ্ছে বই বা নোটবুকে লুকিয়ে। আসছে কুরিয়ারেও। পারিবারিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে থাকা ব্যক্তিদের সন্তানরা দেশে ফেরার সময় এলএসডি নিয়ে আসছেন। ফলে বিমানবন্দরে চেকিংয়ে অনেক সময় তারা ছাড় পাচ্ছেন- এমন অভিযোগও রয়েছে। দেশে যে চালানগুলো ঢুকছে, এর বেশিরভাগই তাদের মাধ্যমে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামসহ একাধিক অ্যাপস ব্যবহার করে বিক্রি হচ্ছে এলএসডি। এই অ্যাপসগুলো অনেক সময় ব্যবহার হচ্ছে বিদেশি সিমের নম্বর দিয়ে। যার নিবন্ধনও দেশের বাইরের। আর ওই অ্যাপস ব্যবহার করা মোবাইল ফোনগুলোয় ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হচ্ছে অন্য ফোনের হটস্পটের মাধ্যমে। ফলে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করেও তাদের শনাক্ত করতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। ঢাকা কাস্টম হাউজের উপ-কমিশনার মো. সানোয়ারুল কবির বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে যদি এলএসডি শনাক্তের প্রক্রিয়া জানানো হয় তাহলে আমাদের জন্য সহজ হবে। কারণ স্ক্যানিংয়ে স্বর্ণ, মুদ্রা বা সিগারেট শনাক্ত করা গেলেও এই মাদক শনাক্ত করা কঠিন। বিমানবন্দর দিয়ে এলএসডি প্রবেশ বন্ধ করতে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করবে ঢাকা কাস্টমস হাউজ। অন্যান্য দেশে লাগেজগুলো সব স্ক্যানিং হয়ে আসে। আমাদের দেশে ম্যানুয়ালি সেটা করতে হয়। ফলে যেহেতু সবাইকে স্ক্যান করা হয় না, তাই মাদক আনার সুযোগ থাকতেই পারে।
বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোহাম্মদ জিয়াউল হক জিয়া বলেন, কোনো যাত্রী যদি পেটের মধ্যে কোনো অবৈধ জিনিস নিয়ে আসে সেক্ষেত্রে স্ক্যানিং মেশিনে ধরা সম্ভব নয়। বিমানবন্দরে ধরে ধরে প্রতিটি যাত্রীকে চেক করা অনেক সময়সাপেক্ষ। এখন পাকস্থলীতে করে ইয়াবা নিয়ে আসছে অনেকেই। এটা ধরতে গেলে এক্স-রে করা ছাড়া সম্ভব নয়। সব যাত্রীকে ধরে ধরে এক্স-রে করাও সম্ভব নয়। এ জন্য আমাদের ম্যানুয়ালি খেয়াল রাখতে হয় এবং ইন্টেলিজেন্সের ওপর ডিপেন্ড করতে হয়। সন্দেহভাজন কাউকে পেলে আমরা এক্স-রে করি। বিমানবন্দর দিয়ে মাদক আসা বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস) কুসুম দেওয়ান বলেন, উন্নত দেশগুলোর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে ডগ স্কোয়াড কাজ করে। আমাদের দেশের বিমানবন্দরে মাদক ঠেকাতে ডগ স্কোয়াড সংযুক্ত হতে যাচ্ছে। মাদক উদ্ধার ছাড়াও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা তল্লাশি ও বিস্ফোরক দ্রব্য শনাক্তে ব্যবহার হবে ডগ স্কোয়াড। এতে বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে।