করোনায় কাজ হারিয়ে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:১২ এএম, ১ জুলাই,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০১:০৪ পিএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় গত বছর ৮ মার্চ। তখনো কাজ পেতেন রাজমিস্ত্রি আলামিন হোসেন। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি, এরপর একের পর এক লকডাউনে তিনি কাজ পাননি। এখন তার তিন মাসের বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে। স্ত্রী আর সন্তানের মুখে তিন বেলা খাবার তুলে দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। কাজের আশায় বাড়ি থেকে বের হলেও কাজ মেলে না। ১৮ জুন সপরিবারে লঞ্চে করে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যান আলামিন। লঞ্চে দেখা যায় তার সংসারের নানা জিনিসপত্র। আবেগতাড়িত আলামিন বলেন, ‘কখনো ভাবিনি এই ঢাকা শহর ছেড়ে আমাকে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। আমার খুব খারাপ লাগছে। করোনা আমার জীবনটারে একেবারে ওলট-পালট করে দিয়েছে।’
শুধু আলামিন নন, এই করোনাকালে আরও বহু পেশার লোক স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২ হাজার ৩৭১ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে ব্র্যাক মে মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এতে দেখা যায়, ৩৬ শতাংশ লোক চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। ৩ শতাংশ লোক চাকরি থাকলেও বেতন পাননি। আর দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে যারা কাজ করেন, তাদের ৬২ ভাগই কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। করোনার কারণে ১০টি জেলার মানুষের আয় কমে গেছে। ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ ভাগ।
করোনার প্রভাবে ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করা মানুষ ব্যয় কমানোর জন্য বাসা বদল করছেন, অনেকে গ্রামেও চলে যাচ্ছেন। এলাকার দেয়ালে বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপন-সংবলিত পোস্টার সেঁটে দিচ্ছেন বাড়ির মালিকরা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বললেন, মানুষ যে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে, তা আমরা জানি। কাজ না থাকলে ঢাকায় মানুষ কীভাবে থাকবে? যারা কাজ হারিয়েছেন, ঘরভাড়া দিতে পারছেন না, তাদের অনেককেই ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা উপসচিব এ কে এম লুৎফর রহমান সিদ্দিক বলেন, শুধু বস্তিবাসীই যে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন তা নয়, চাকরিজীবীদের অনেকেও গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। বিশেষ করে যারা মেসে থাকতেন, তাদের অনেকে চলে যাচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা শুধু আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনেনি, মানসিক বিপর্যয়ও ডেকে নিয়ে এসেছে। করোনায় কাজ হারানো, চাকরি হারানো মানুষগুলোর যদি আবার কর্মসংস্থানের সুযোগ না হয়, তাহলে আরও বিপদ। যে লোকটা বাড়িভাড়া দিতে না পেরে গ্রামে ফিরে গেলেন, তার জীবনমান নেমে যাবে। একই সঙ্গে বাড়িওয়ালারও জীবনমান নামবে। করোনায় জীবনের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটা ভেঙে যাচ্ছে।
‘টু-লেট’ আর ‘টু-লেট’: রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দনিয়ার আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পাশাপাশি তিনটি বড় ভবন। প্রতিটি ভবনের সামনে ঝুলছে ‘টু-লেট’। প্রতিটি ভবনে চার থেকে পাঁচটি ফ্ল্যাট খালি। শুধু এই তিনটি ভবন নয়, দনিয়া এলাকাসহ রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় বাসার সামনে টু-লেট দেখা যাচ্ছে। রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তত ১৫ জন কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, করোনার কারণে সাধারণ ছুটি থাকার সময় কাজ না থাকায় দুই থেকে তিন মাসের বাসাভাড়া দিতে পারেননি অনেকে। এখনো কাজের সুযোগ কম থাকায় অনেকে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন।
ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের (যাত্রাবাড়ী এলাকা) মোশতাক আহমদ বললেন, ‘কাজ না থাকায়, বাসাভাড়া না দিতে পারায় অনেক লোক যে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তা আমি ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছি। আমার পাঁচতলা একটা বাসা আছে। ওই বাসায় ১৮টি পরিবার বসবাস করত। করোনার কারণে ইতিমধ্যে পাঁচটি পরিবার চলে গেছে। আমরা যারা ভাড়ার টাকায় চলি, তারা খুবই কষ্টে আছি। যারা ছোটখাটো কাজ করে ঢাকায় পরিবার নিয়ে চলেন, তারা আর টিকতে পারছেন না। পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন।’ পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের নবদ্বীপ বসাক লেনে লন্ড্রির ব্যবসা করেন নাসির হোসেন। তার দোকানের এক কর্মচারী গ্রামে চলে গেছেন।
তিনি বলেন, এখন কাজ নেই। বহু লোক ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। কারণ বাসাভাড়া দিতে পারছেন না। ঢাকায় থেকে কী করবেন? পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার, ওয়ারী, গেন্ডারিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে অনেক বাসা খালি দেখা যায়।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, পুরান ঢাকায় এর আগে কখনো এক সঙ্গে এত বাসা খালি হয়নি। এত টু-লেট দেখা যায়নি। লালবাগ এলাকার কাউন্সিলর মকবুল হোসেন বলেন, ‘লকডাউনে কাজ-কাম বন্ধ। সবাই তো পঙ্গু হইয়া গেছে গা। এই কারণে অনেকে দ্যাশে চলে যাচ্ছেন। আমার পাশের বাড়ির এক ভাড়াটে বাদে সবাই চলে গেছেন। বাসাগুলো এখন খালি পড়ে আছে। প্রতিটি বাড়ির একই অবস্থা।’
ঢাকার মিরপুর এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন বরিশালের আলম হোসেন। করোনায় কাজ বন্ধ থাকায় ঘর ভাড়া দিতে পারছিলেন না। বাড়ি থেকে টাকা এনে ঘর ভাড়া পরিশোধ করেন। কাজ কমে যাওয়ায় পরিবারসহ বরিশাল চলে যাচ্ছেন। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার বাসিন্দা আবু বকর। আগে ব্যবসা করতেন, এখন ঢাকায় ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে সংসার চালান। করোনার আগে-পরে মাসে তার ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় ছিল। কিন্তু করোনায় সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর বদলে গেছে তার জীবন। বন্ধের সময় আয় হয়নি। তিন মাসের ঘরভাড়াও দিতে পারেননি। এখন আবার মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিচালক (প্রোগ্রাম ও ইনফরমেশন) কোহিনূর মাহমুদ বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত সারা দেশের প্রায় এক কোটি লোক কাজ হারিয়েছেন। আর তৈরি পোশাক খাতে কাজ হারিয়েছেন এক লাখ লোক।
করোনায় সামগ্রিক অর্থনীতি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য।
তিনি বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে আমাদের অর্থনীতি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। অর্থাৎ যার বাড়ি ভাড়া দেয়ার ক্ষমতা ছিল, তার এখন আর সেই ক্ষমতা থাকছে না। আর যিনি বাড়ি ভাড়া দিয়ে রেখেছিলেন, তিনি বাড়ি ভাড়া পাবেন না। সামগ্রিকভাবে এই লোকগুলোর সবাই ক্রমান্বয়ে জীবনমানের দিক দিয়ে অনেক নিচে নেমে যাচ্ছেন। কেউ কেউ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। এই জায়গাতে তারাই যাবেন, যারা তুলনামূলকভাবে অস্থায়ী চাকরি করতেন। খন্ডকালীন কাজ করতেন। এটাই হলো করোনার এই মহামারিতে অর্থনীতির অভিঘাতের বড় জায়গা।