চলে গেলেন কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
আবদুল্লাহ জেয়াদ, দিনকাল
প্রকাশ: ০৫:৫৭ এএম, ১৬ নভেম্বর,সোমবার,২০২০ | আপডেট: ০২:১১ পিএম, ২২ অক্টোবর,মঙ্গলবার,২০২৪
দীর্ঘদিন লড়াইয়ের পর মৃত্যুর কাছে হার মানলেন সত্যজিৎ রায়ের অপু খ্যাত উপমহাদেশের প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আজ রবিবার ভারতীয় সময় দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হাসপাতালের ৪১ দিনের যুদ্ধ।
হাসপাতাল সূত্র বলছে, কোভিড এনসেফ্যালোপ্যাথির কারণেই সব রকম চিকিৎসার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরেণ্য এই অভিনেতার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।
এর আগে বেলভিউ হাসপাতলের এক চিকিৎসক জানান, প্রবীণ অভিনেতার স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব ফেলেছে কোভিড এনসেফ্যালোপ্যাথি। তার জেরে ‘সব চেষ্টা’ ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। গত ৪০ দিন ধরে নিউরোলজি, নেফ্রোলজি, কার্ডিওলজি, ক্রিটিকাল কেয়ার মেডিসিন, আইডি বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের একটি দল তাঁর চিকিৎসায় যুক্ত ছিলেন। ওই চিকিৎসকের কথায়, ‘স্টেরয়েড, ইমিউনোগ্লোবুলিন (অ্যান্টিবডি), কার্ডিয়োলজি, অ্যান্টি-ভাইরাল থেরাপি, অনাক্রম্যতা- সব রকমের চেষ্টা করেছি আমরা।
গত ১ অক্টোবর থেকে বাড়িতে থাকাকালীন তাঁর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হন। তবে করোনার কোনো উপসর্গ পাওয়া যায়নি। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হলে ৫ অক্টোবর তাঁর কোভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট আসে। ৬ অক্টোবর তাঁকে ভর্তি করানো হয় বেলভিউ নার্সিং হোমে। এখানে সর্বশেষ ১৪ অক্টোবর তাঁর করোনার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। গত ২৪ অক্টোবর রাত থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থার মূলত অবনতি হতে থাকে। এরপর ধীরে ধীরে তিনি চেতনাহীন হয়ে পড়েন। তাঁকে সুস্থ করার জন্য গত বৃহস্পতিবার প্লাজমা থেরাপি দেয়া হয়। এর আগে বুধবার কিডনির ডায়ালাইসিস করা হয়। শুক্রবার বিকেলে তাঁর হৃদস্পন্দন হঠাৎ করে বেড়ে যায়, রাতে চেতনা স্তর ৫-এ নেমে যায়। সর্বশেষ তাঁকে বিভিন্ন ধরনের লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
গতকাল রবিবার তাঁকে দেয়া হয়েছিল শতভাগ ভেন্টিলেশন সাপোর্ট। রক্তচাপ, হার্টবিট, হার্ট রেট স্বাভাবিক করার জন্য যা যা ওষুধ দরকার, সব দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুতেই চিকিৎসায় তিনি সাড়া দেননি। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়, তিনি বিদায় নেন প্রকৃতির নিয়মে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘অপুর সংসার’ সিনেমায় অভিনয় করেন। অভিনেতা হিসেবে তিনি কিংবদন্তি, তবে আবৃত্তি শিল্পী হিসেবেও তার নাম অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথেই উচ্চারিত হয়। তিনি কবি এবং অনুবাদকও। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি সিনেমার ভিতর ১৪ টিতে অভিনয় করেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সবকিছু নিয়েই অনন্য। তিনি এমনই এক শিল্পী, যাঁর মূল্যায়ন নিয়ে কোনো পন্ডিতি-তর্ক তোলার অবকাশ রাখে না। বলা হতো সময়ের ধুলা তাঁর আভিজাত্যের সৌন্দর্য স্পর্শ করতে পারে না। সেই সৌমিত্রের সময় আজ চিরতরে থেমে গেল, ৮৬-তে এসে থামলেন তিনি। চলে গেলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু’ অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে তিনি মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মত পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। সিনেমা ছাড়াও তিনি বহু নাটক, যাত্রা এবং টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন।
১৯৩৫-এর ১৯ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় জন্ম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। বাবা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী। জীবনের প্রথম ১০টা বছর সৌমিত্র কাটিয়েছিলেন কৃষ্ণনগরে। তাঁর দাদার নাটকের দল ছিল। বাড়িতে নাট্যচর্চার পরিবেশ ছিল। ছোটবেলা থেকেই নাটকে অভিনয় শুরু করেন তিনি। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে সৌমিত্র ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। কলেজের ফাইনাল ইয়ারে হঠাৎ একদিন মঞ্চে শিশির ভাদুড়ীর নাটক দেখার সুযোগ হয় তাঁর। সেদিনই জীবনের মোড় ঘুরে যায় তাঁর। তিনি পুরোদস্তুর নাটকে মনোনিবেশ করেন।
চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহের আমল থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন। সৌমিত্রের পিসিমা তারা দেবীর সঙ্গে ‘স্যার’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র কলকাতা হাইকোর্টের জাস্টিস রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়। সৌমিত্রের পিতৃদেব কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন এবং প্রতি সপ্তাহান্তে বাড়ি আসতেন। সৌমিত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন কৃষ্ণনগরের সেন্ট জন্স বিদ্যালয়ে। তারপর পিতৃদেবের চাকরি বদলের কারণে সৌমিত্রের বিদ্যালয়ও বদল হতে থাকে এবং উনি বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেন হাওড়া জিলা স্কুল থেকে। তারপর কলকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি এবং পরে বিএ অনার্স (বাংলা) পাস করার পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস-এ দু-বছর পড়াশোনা করেন।
শিশির ভাদুড়ীকে গুরু মানতেন সৌমিত্র। নিজেই বলেছেন, অদ্ভুত এক বন্ধুত্ব ছিল তাঁদের। সব রকম আলোচনা হতো দুজনের। বাংলা সিনেমা জগতের আরেক কিংবদন্তি ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে সৌমিত্রকে পরিচয় করিয়ে দেন সত্যজিৎ নিজেই। সিনেমার জগতে হাতেখড়ি হয় সৌমিত্রর সে সময়। ‘অপুর সংসার’-এ অপু হন তিনি। প্রথম ছবিতেই আলোচনায় এসেছিলেন।
জানা যায়, সে ছবির শুটিংয়ে প্রথম দিনের ফার্স্ট শটেই সিন ওকে। ছবিতে ‘খাওয়ার পর একটা করে, কথা দিয়েছ’, তাঁর আর শর্মিলা ঠাকুরের সেই সংলাপ, রসায়ন এখনো বাঙালি মননে অমলিন। পরে একে একে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দেবী’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘চারুলতা’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’সহ বহু ছবি করেছেন তিনি। সত্যজিতের সৃষ্টি ‘ফেলুদা’কে বড় পর্দায় জীবন্ত করেছিলেন তিনিই। ফেলুদা পরে বহুবার হয়েছে ছোট ও বড় পর্দায়। কিন্তু যেকোনো বাঙালি একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, সৌমিত্রের মতো ফেলুদা আর কেউ নন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র : অপুর সংসার, ক্ষুদিত পাষাণ, দেবী, তিন কন্যা, ঝিন্দের বন্দী, অতল জলের আহ্বান, বেনারসী, অভিজান, সাত পাকে বাঁধা, চারুলতা, কিনু গোয়ালার গলি, বাক্স বদল, কাপুরুষ, একই অঙ্গে এত রূপ, আকাশ কুসুম, মণিহার, কাঁচ কাটা হীরে, হাটে বাজারে, অজানা শপথ, বাঘিনী, তিন ভুবনের পাড়ে, পরিণীতা, অপরিচিত, অরণ্যের দিনরাত্রি, প্রথম কদম ফুল, মাল্যদান, স্ত্রী, বসন্ত বিলাপ, অশনি সংকেত, সোনার কেল্লা, সংসার সীমান্তে, দত্তা, জয় বাবা ফেলুনাথ, দেবদাস, গণদেবতা, হীরক রাজার দেশে, ঘরে বাইরে, আতঙ্ক, গণশত্রু, শাখা প্রশাখা, তাহাদের কথা (১৯৯২), মহাপৃথিবী (১৯৯২), হুইল চেয়ার, পারমিতার একদিন
অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন সৌমিত্র। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান ‘অফিসার ডেস আর্ট এট মাস্টার’ পেয়েছেন। সত্তরের দশকে তিনি পদ্মশ্রী পান কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে তিনি পদ্মভূষণ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে পান সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। ২০০১ ও ২০০৮ সালে তিনি চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার পান। ২০০৪ সালে তাঁকে পদ্মভূষণে সম্মানিত করা হয়। এ ছাড়া জাতীয় পুরস্কার, দাদাসাহেব ফালকেসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি আবৃত্তি, রবীন্দ্রপাঠ, সম্পাদনা, নাট্যসংগঠন করেছেন তিনি। ২০১২ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬০ সালে সৌমিত্র বিয়ে করেন দীপা চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে পৌলমী চট্টোপাধ্যায় সংস্কৃতি চর্চা করেন।
সৌমিত্রদার কথা শুনতাম মুগ্ধ হয়ে : ববিতা
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে অনেকের মতোই শোকাতুর বাংলাদেশের অভিনেত্রী ববিতা। ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে সৌমিত্রের স্ত্রী ‘অনঙ্গ বউ’ চরিত্রে অভিনয় করেন ববিতা। ছবিটি পরিচালনা করেন সত্যজিৎ রায়। ছবিটির জন্য অস্কার পান পরিচালক। আর এই ছবির মাধ্যমেই ববিতার নাম ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সৌমিত্রকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটে অভিনেত্রী ববিতার। ববিতা বলেন, যখন শুনলাম সৌমিত্রদা হাসপাতালে তখন থেকে তার জন্য দোয়া করে যাচ্ছিলাম- তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক। কিন্তু তিনি ফিরলেন না! সবাইকে ছেড়ে চলেই গেলেন। খুব খারাপ লাগছে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ক্যারিয়ারে একটি ছবি ববিতার সঙ্গে করলেও দুজনের মধ্যে বেশ সখ্যতা ছিল। বাংলাদেশে এলে ববিতার সঙ্গে দেখা করতেন সৌমিত্র, দীর্ঘ সময় আড্ডাও হতো। স্মৃতিচারণ করে ববিতা বলেন, সৌমিত্রদার সঙ্গে আমার কত স্মৃতি... এগুলো কয়েক মিনিটে বলা সম্ভব নয়। অশনি সংকেত ছবির শুটিংয়ের অনেক স্মৃতিই মনে পড়ছে। ছবিটির দৃশ্য ধারণ হয় শান্তিনিকেতন ও বীরভূমে। সিনেমাটি যেখানে চিত্রায়ণ হয়, সেই সেট ছিল ছবির মতো সাজানো-গোছানো। ছবিটিতে যখন অভিনয় করি, তখন আমার বয়স ছিল কম। সত্যজিৎদা, সৌমিত্রদা আমাকে কতটা সাহায্য করেছেন, তা বলে বোঝানো যাবে না। তারা ছিলেন বলেই আমি ‘অনঙ্গ বউ’ হয়ে উঠতে পেরেছিলাম।