২৫ দিনের ব্যবধানে আবারো বন্ধ জিকে সেচ প্রকল্প
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:৩৩ পিএম, ২১ এপ্রিল,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:৪৮ এএম, ১৬ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২৪
মাত্র ২৫ দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় বারের মতো বন্ধ হয়ে গেছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের পানি সরবরাহ। জিকের কর্মকর্তারা বলছেন পদ্মা নদীতে ঠিকমতো পানি না পাওয়ার কারনে আবারো এ ঘটনা ঘটেছে।
তারা আরো বলছেন ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তির আলোকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পানি বন্টন করতে গিয়ে এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া, তারা এ বছর বৃষ্টির দুস্প্রাপ্যতাকেও এ ঘটনার জন্য দুষছেন।
জিকে পাম্প হাউসের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান পাম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন গত রবিবার ভোরে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই জিরোতে নেমে আসে দুটি প্রধান পাম্প। তারপর মঙ্গলবার দুপুর থেকে একইসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় আরও ১২টি বিভিন্ন ধরনের স্বয়ংক্রিয় সম্পূরক পাম্প। গত ২৬ মার্চ প্রথম বন্ধ হয়ে যায় পাম্প। ৫ এপ্রিল থেকে তা চালু হয়।
মিজানুর রহমান জানান পাম্প হাউসের ইনটেক চ্যানেলে এখন মাত্র চার মিটার আরএল (রিডিউসড লেভেল) পানি পাওয়া যাচ্ছে। সেচের পানি সরবরাহ করতে হলে ইনটেকে পানি থাকতে হবে ১৪ দশমিক পাঁচ মিটার আরএল। পানি সরবরাহ চার দশমিক পাঁচ মিটার আরএলের নিচে নামলে পাম্প মেশিন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। জিকের কর্মকতারা জানাচ্ছেন সেচ প্রকল্পটি পদ্মার পানির ওপর নির্ভরশীল।
পদ্মায় পানির প্রাপ্যতা সাপেক্ষে চলে আসছে প্রকল্পটি। সেখানে পানি কম থাকলে জিকের ইনটেকে পানি প্রবাহ নেমে যাবে এবং তারা পানি সরবরাহ করতে পারবে না। প্রতিবছর জানুয়ারির মধ্যভাগ থেকে শুরু হয় জিকে প্রকল্পে পানি সরবরাহ। এ বছর ১৫ জানুয়ারি সেচ পাম্প চালু করা হয়েছিল এবং অব্যাহত ছিল পানি সরবরাহ। চালুর পর থেকে পাম্প দুটি ১০ মাস নিরবচ্ছিন্নভাবে চালানো হয়।
এ পানিতে দুটি মৌসুমে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার এক লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ কার্যক্রম চলে। এই চার জেলার মোট ১৩টি উপজেলায় এই সেচ কার্যক্রম বিস্তৃত। প্রকল্পের মূল পয়েন্ট কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পানি সংরক্ষণ খাল থেকে মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুরে পানি সরবরাহের শেষ পয়েন্ট পর্যন্ত ১৯৪ কিলোমিটার প্রধান খালে সেচ দেয়া হয় এ প্রকল্প থেকে।
জিকে প্রকল্পের হাইড্রোলজি বিভাগ সূত্রে জানা যায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ গত রবিবার থেকে কমে যেতে থাকে। মঙ্গলবার দুপুরে একেবারে কমে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ২৪ হাজার কিউসেক। কিন্তু জিকে সেচ চালু রাখতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ প্রয়োজন কমপক্ষে ৩৪ হাজার কিউসেক।
তারা বলছেন পানি কমে যাওয়ার কারন হলো ভারতে এখন গঙ্গা থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুষ্টিয়া বেসিনের কর্মকর্তারা বলছেন পদ্মা নদীর এই পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয় ১৯৯৬ সালের ভারত-বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গঙ্গা-পানি চুক্তির আলোকে।
জিকে প্রকল্পের হাইড্রোলজি বিভাগের নিবার্হী কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জানান গঙ্গার পানি চুক্তি অনুযায়ী প্রাপ্য পানি নিশ্চিত করতে প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের প্রতিনিধি দল ফারাক্কা পয়েন্ট ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে থাকে। গত জানুয়ারি থেকে দুই দেশের যৌথ পানি পর্যবেক্ষণ শুরু হয়েছে। প্রতি ১০ দিন অন্তর পানির পরিমাণ পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রইচ উদ্দিন বলেন পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে প্রতি ১০ দিনের হিসাবের ভিত্তিতে ফারাক্কায় পানির প্রবাহ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বণ্টন করা হয়। প্রথম ১০ দিনে ফারাক্কায় ৭০ হাজার কিউসেক বা তার কম পানির প্রবাহ থাকলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই ৫০ শতাংশ করে পানি পাবে।
দ্বিতীয় ১০ দিনে ফারাক্কা পয়েন্টে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কিউসেক প্রবাহ থাকলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে এবং অবশিষ্ট পানি পাবে ভারত। তৃতীয় ১০ দিন ফারাক্কা পয়েন্টে ৭৫ হাজার কিউসেক বা তার বেশি পানি প্রবাহ থাকলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক পানি, বাকিটা পাবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত ফারাক্কায় পানি প্রবাহ ছিল ৫৯ হাজার ৫২২ কিউসেক এবং বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ ছিল ৩৬ হাজার ৩৯৩ কিউসেক। কিন্তু, ২০ মার্চ থেকে শুরু হয় ভারতের হিস্যা। যার ফলে ভারত গঙ্গা থেকে পানি সরিয়ে নেয়, যা শেষ হয় ৩১ মার্চ। ১ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ পানি পায় ৩৫ হাজার কেউসেক। ১১ এপ্রিল থেকে ভারতের হিস্যা শুরু হয়েছে। চলবে ২২ এপিল পর্যন্ত।
জিকে প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান বলেন এই সময়টিতে বাংলাদেশ ২২ হাজার বা ২৩ হাজার কিউসেকের বেশী পানি পাবার কথা নয়। এই কর্মকর্তা জানান জিকের সেচ চালু রাখতে এবার তাদের একটু বেশীই হিমশিম খেতে হচ্ছে কারন এবার বৃষ্টির দুস্প্রাপ্যতা ঘটেছে। তিনি বলে বৃষ্টি হলে নদীতে পানির প্রবাহটা অব্যাহত থাকে। তখন পানি প্রত্যাহার হয়ে গেলেও পদ্মায় বৃষ্টির নাব্যতা থেকে জিকে পানি টেনে নিতে পারে। কিন্তু এবার সেমনটি করতে পারছে না।
তিনি বলেন জিকে পাম্পে পানি আনতে পদ্মা নদী থেকে প্রায় দুই কিলোমিটারের একটি ইনটেক চ্যানেলের সহায়তা নিতে হয় বলে পানির সরবরাহ পর্যাপ্ত না হলে একটু সমস্যা হয়। পানি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, গঙ্গা অববাহিকায় পানি নিয়ে এবার সমস্যা একটু বেশী দেখা দিয়েছে। যার প্রধান কারন বৃষ্টির অপ্রাপ্যতা। এই মৌসুমে এখনও বৃষ্টি হয়নি। ফলে গঙ্গায় পানির মূল প্রবাহ খুবই দুর্বল।
পানি বন্টন করতে গিয়ে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশই সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছে। এদিকে জিকের আওতায় সেচ নির্ভর কৃষকরা বিপাকে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে পাম্প বন্ধ হবার খবরে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শ্যামল কুমার বিশ্বাস। তিনি অনেক জায়গাতে কৃষকদের এখনও পানি প্রয়োজন। তবে কোথাও কোথাও ধানে এখন আর পানি লাগছে না। তবে সার্বিক বিবেচনায় কৃষকদের হাতের নাগালে পানি প্রয়োজন।