ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মা ও ৩৬টি শাখা নদীর বুকে বিশাল চর-ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশ ও চাষাবাদ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:০৯ পিএম, ১ এপ্রিল,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ১২:৪৬ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
ফারাক্কার বিরুপ প্রভাবে প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে। সেই সঙ্গে পদ্মার শাখা-প্রশাখাসহ অন্তত ৩৬টি নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা ও শাখা নদীগুলোর বুকে জেগে ঊঠছে বিশাল বিশাল চর। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ, চাষাবাদ ও নৌ-যোগাযোগে ঘটছে বিঘ্ন।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গঙ্গার উৎস থেকে মাঝপথেই পানি সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। শুধুমাত্র ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প-কারখানা সবকিছুতে মারাত্মক ক্ষতি করেছে। ফারাক্কার কারনে যশোর-খুলনা অঞ্চলে মিঠাপানির প্রবাহ কমে গেছে। পদ্মার তলদেশ ওপরে উঠে এসেছে। এখন পদ্মায় তেমন ইলিশ পাওয়া যায় না। দুইশতাধিক প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি ছিল, এখন আর দেখা মেলেনা। সেগুলোর অধিকাংশই এখন বিলুপ্তির পথে। পদ্মা নদীতে পানি স্বল্পতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে মরুকরণ অবস্থা স্থায়ী রুপ নিতে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র হুমকীর মুখে পতিত হয়েছে। পদ্মা পাড়ে এখন আর গাঙচিল, মাছরাঙা আর বেলেহাঁস দেখা যায় না।
জানা যায়, সমুদ্র থেকে ৪২ ফুট উচুঁতে অবস্থিত হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্ট থেকে ভারত সীমান্ত ত্রিশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের আঠার কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ অবস্থিত। এই নদীতে বাঁধ দেয়া হয়েছে প্রথমে হরিদ্বারে। শেষে ফারাক্কায়। পদ্মা নদী রাজশাহী, পাবনা ও ফরিদপুর জেলা হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। হার্ডিঞ্জ সেতুর উজানে রয়েছে পদ্মার পানি পরিমাপের মিটার গেইজ। এখানে বাংলাদেশ ও ভারতের পানি বিভাগের কর্মকর্তারা পানি মাপেন। ভারত সরকার গঙ্গার পানি রোধে ১৯৫১ সালে মুর্শিদাবাদ জেলায় ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ১৯৭৫ সালে শুরু হয় ফারাক্কা ব্যারেজের কার্যকারিতা। এরপর থেকেই মরে যেতে থাকে পদ্মা ও শাখা নদীগুলো। যশোর-কুষ্টিয়ার অনেক নদী পদ্মার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে। পদ্মার প্রধান শাখা নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, ভৈরব, মাথা ভাঙ্গা, কুমার, কপোতাক্ষ, পশুর, বড়াল, মাথাভাঙ্গা, ইছামতি, গড়াই, আড়িয়ালখা প্রভৃতি।
পদ্মার পানি দিয়ে শুকনো মওসুমে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় সেচকাজ চালানো হয়। এ নদীর পানি দিয়ে প্রায় ২০ ভাগ জমির সেচকাজ চলে। ভারত পানি প্রত্যাহারের যে একতরফা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে- তাতে বাংলাদেশের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সাথে ফারাক্কা পয়েন্ট প্রবাহ ভিত্তিতে '৩০ বছর' মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে বিভিন্ন প্রবাহ পরিস্থিতি অনুযায়ী বন্টন ব্যবস্থা নির্ধারণ করা হয় এবং ১৯৭৭-১৯৮৯ সাল অবধি গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহকে বেঞ্চ মার্ক হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। লক্ষণীয়, এই সময়টাতে ভারত ইতিমধ্যেই ফারাক্কার উজান থেকে ব্যাপক হারে পানি অপসারণ শুরু করে। সুতরাং ফারাক্কা পয়েন্টে পানি ভাগাভাগি শুভংকরের ফাঁকি ছাড়া আর কিছুই না। এই চুক্তিতে বাংলাদেশকে খরার মওসুমে ৩৫,০০০ কিউসেক পানি দেয়ার গ্যারান্টি রয়েছে অথচ খরার সময় পদ্মা এবং তার শাখা প্রশাখাদের বাচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় নূন্যতম ৬০,০০০ কিউসেক।
বাংলাদেশ ও ভারতের ছয় সদস্যের বিশেষজ্ঞ টিম (২জানুয়ারি) থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি পরিমাপের কাজ শুরু করছেন। ৩১ মে পর্যন্ত এ পরিমাপ ও পর্যবেক্ষণ চলবে। পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী রইচ উদ্দিন এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ভারত থেকে দুজন আর বাংলাদেশ থেকে চারজনের বিশেষজ্ঞ টিম পর্যবেক্ষণ কাজ করছেন। ভারতের প্রতিনিধিরা হলেন- কেন্দ্রীয় নদী কমিশনের উপ-পরিচালক (ডিডি) শ্রী ভেংক্টেশ্বর লুই এবং সিডবিউসির সহকারী পরিচালক (এডি) নগেন্দ্র কুমার।
বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে রয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী সাইফুদ্দিন আহমদ, প্রকৌশলী রেজাউল করিম প্রকৌশলী সুমন মিয়া এবং উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সিব্বির হোসেন। পাউবো উত্তরাঞ্চলীয় পরিমাপ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোর্শেদুল ইসলাম জানান, বর্তমানে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে প্রায় ৮৮ হাজার কিউসেক পানি বিদ্যমান। গত বছর ১ জানুয়ারি থেকে প্রথম ১০ দিনে ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গায় এক লাখ ৬১ হাজার কিউসেক পানি ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল ৬০ হাজার ৬১ কিউসেক এবং ভারতের ৪০ হাজার কিউসেক পানি। একই সময় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির পরিমাণ ছিল এক লাখ দুই হাজার ৫৭৪ কিউসেক পানি। গত বছরের তুলনায় এবার পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পয়েন্টে অন্তত ১৪ হাজার কিউসেক পানি কম বিদ্যমান। চুক্তির শর্তানুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে প্রতি ১০ দিন পর পর পানি প্রাপ্তির তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে এবং তা ৩১ মে পর্যন্ত চলবে। ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে ফারাক্কায় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের জীবন রেখা পদ্মা নদীকে অবমুক্ত করার লক্ষ্যে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চ।
বাংলাদেশের আনাচে কানাচে থেকে সমাগত ৫০ হাজার পদাতিকের রাজশাহী থেকে কানসাট সীমান্ত অবধি ৪৪ মাইল পদযাত্রা শেষে বিশাল জনসমুদ্রে অশতিপর বৃদ্ধ মাওলানা বিশ্বজনতার প্রতি বলেছিলেন, 'গঙ্গার পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিতে ভারত সরকারকে বাধ্য করার জন্য আমাদের আন্দোলন, আমি জানি, এখানেই শেষ নয়'। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এসব অঞ্চলে মরুকরণ হওয়ার উপক্রম হতে বসেছে। পরিবেশের উপর মারাত্মক বিপর্যয় নেমে এসেছে। এ অবস্থা থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীগুলো এবং পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখতে হলে সরকারকে অবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।