রাতেও ঘন ঘন লোডশেডিং
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৪০ পিএম, ১১ অক্টোবর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ১২:৩৭ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
লোডশেডিং এখন আর সময় মানছে না। সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা, রাত, মধ্যরাত কিংবা ভোর রাত লোডশেডিং থাকছে সবসময়। মানুষের সবচে বড় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সারারাত জুড়ে লোডশেডিং। মানুষের রাতে ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। রাতে ঠিক মতো না হচ্ছে ঘুম। ফলে সারাদিনের কার্যাক্রমে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। সরকার কথা দিয়েছিলো অক্টোবর থেকে লোডশেডিং কমে আসবে । কিন্তু বাস্তবে ঘটলো উল্টো ঘটনা। এ সময়ে এসে বেড়ে গেছে লোডশেডিং। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের লোডশেডিংয়ের চিত্র একই রকম। জ্বালানির অভাবে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। পড়ে থাকছে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা। আর ঘরে ও শিল্পে মানুষ ভুগছেন বিদ্যুতের অভাবে।
লোডশেডিং বাড়ায় অসীম ভোগান্তিতে পড়ছেন মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিদ্যুতের সীমাহীন কষ্টের কথা তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। ঢাকার বাইরে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাধীন এলাকায় ১০ট থেকে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করা হয়েছে। এখন তা বেড়ে হয়েছে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত, যা গত তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তিন থেকে চার ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না এখন। আর ঢাকার বাইরে কোনো কোনো এলাকায় ৭ থেকে ১৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ময়মনসিংহ বিভাগে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) আওতাধীন এলাকায় দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি) আমদানি কমানো হয়েছে। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কমেছে। বিল বকেয়া বাড়তে থাকায় তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকেও চাহিদামতো উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আগাম শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কমার ভরসায় ছিল সরকার। গরম না কমায় সেটিও কাজে আসেনি। তাই অক্টোবরে লোডশেডিং বন্ধ করার পুরোনো সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার।
গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় গত রবিবার রাত থেকে গতকাল সোমবার বিকেল পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি আগের মতোই অবনতিশীল ছিল। এ তিন জেলায় ৭ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে। তবে অবস্থার উন্নতি দেখা গেছে রাজশাহী ও রংপুরে। ৪৬২ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে ২২৫ মেগাওয়াট। এতে এলাকাভিত্তিক ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
এদিকে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার নওপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, সেখানে দিন-রাত মিলিয়ে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। তারাকান্দা উপজেলার লারমা গ্রামের বাসিন্দা ফারুক আহমেদ বলেন, গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এক ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ আসে আর যায়। তিনি বলেন, সম্প্রতি সেখানে রাতের বেলায় বিদ্যুতের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩-এর মহাব্যবস্থাপক খন্দকার শামীম আলম বলেন, ময়মনসিংহের ছয়টি উপজেলার জন্য গড় চাহিদা ৮৮ মেগাওয়াট, তবে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৪০ মেগাওয়াট।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সিএনজি ফিলিং স্টেশন বন্ধ রাখার সময় আরও ২ ঘণ্টা বাড়িয়ে মোট ৭ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে চাচ্ছে পেট্রোবাংলা। এদিকে, গতকাল সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেছেন, গ্যাস আনতে না পারায় নভেম্বরের আগে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতির আশা নেই। লোডের কারণে আমরা দিনের বেলা কিছু পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ রাখছি। আবার দিনে যেগুলো চালাচ্ছি সেগুলো রাতে বন্ধ রাখছি। এজন্য লোডশেডিংয়ের জায়গাটা একটু বড় হয়ে গেছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা চেয়েছিলাম অক্টোবর থেকে কোনো লোডশেডিংই থাকবে না। কিন্তু সেটা আমরা করতে পারলাম না। কারণ আমরা গ্যাস আনতে পারিনি। সমস্যাটা সাময়িক হতে পারে। তবে আমি মনে করি, বললেই এটা সাময়িক হচ্ছে না। কারণ বিশ্ব পরিস্থিতি আবার অন্যরকম করে ফেলে। তিনি বলেন, অক্টোবর মাসটা একটু কষ্ট করতে হবে। আশা করছি, সামনের মাস থেকে আরেকটু ভালো হবে। নভেম্বর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অক্টোবর থেকে ভালো পরিস্থিতি হয়ে যাবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু শিল্পে চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই আমরা বিদ্যুতে গ্যাস কমিয়ে দিয়েছি। বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলায় গত ১৯ জুলাই থেকে দিনে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তখন থেকেই রাজধানীতে দুই থেকে চার ঘণ্টা এবং ঢাকার বাইরে ছয় থেকে আট ঘণ্টা লোডশেডিং করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, সেপ্টেম্বরের শেষদিকে লোডশেডিং থাকবে না। অক্টোবর থেকে পুরোপুরি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের কথা বলেছিল বিদ্যুৎ বিভাগ।
তারপরেও কেন বিদ্যুতের লোডশেডিং, প্রশ্ন সাধারণদের। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)-এর হিসাব অনুযায়ী, ১০ অক্টোবর কর্মদিবসে সারা দেশে সন্ধ্যায় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয় ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এই সময়ে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ধরা হয়েছিল ১২ হাজার ৬৮৬ মেগাওয়াট। তাতে লোডশেডিং ধরা হয় ১ হাজার ৩৯৫ মেগাওয়াট। প্রাক্কলিত সর্বনিম্ন উৎপাদন ধরা হয় ৯ হাজার ৯৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের। পিডিবির ওয়েব সাইটে উল্লিখিত বিদ্যুতের লোডশেডিং পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকায় লোডশেডিং ধরা হয়েছে ৫৬৫ মেগাওয়াট এবং চাহিদা ৪ হাজার ৪১৯ মেগাওয়াট, চট্টগ্রাম এলাকায় লোডশেডিং ১৫৫ মেগাওয়াট এবং চাহিদা ১ হাজার ২৫২ মেগাওয়াট, খুলনা এলাকায় ১৬০ মেগাওয়াট এবং চাহিদা ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৫২ মেগাওয়াট, রাজশাহী এলাকায় ১৪০ মেগাওয়াট লোডশেডিং এবং চাহিদা ১ হাজার ৪৬৬ মেগাওয়াট, কুমিল্লা এলাকায় ১২০ মেগাওয়াট এবং চাহিদা ১ হাজার ২৪৮ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহে ১১০ মেগাওয়াট লোডশেডিং এবং চাহিদা ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩১ মেগাওয়াট, সিলেটে ৪৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং এবং চাহিদা ৪৬১ মেগাওয়াট, বরিশাল অঞ্চলে লোডশেডিং শূন্য এবং চাহিদা ৩৭৬ মেগাওয়াট, রংপুর অঞ্চলে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং চাহিদা ৮১৪ মেগাওয়াট।
যদিও দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে সাড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। গত ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকের পর দেশে গত ১৯ জুলাই থেকে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় দেশজুড়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়। এ ছাড়া রাত ৮টার পর শপিং মলসহ দোকানপাট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর এবং উপাসনালয়ে প্রার্থনার সময় ছাড়া এসি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হবার আহ্বানও জানানো হয় সরকারের তরফে। রাত ৮টার পর দোকানপাট, মার্কেট, শপিংমল খোলা থাকলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। রাত ৮টা থেকে কোনোরকম দোকানপাট, শপিংমল, আলোকসজ্জা-সব বন্ধ থাকবে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ বিভাগকে বলা হয়েছে, তারা খুব কঠিনভাবে এ বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করবেন। যদি কেউ অমান্য করেন তাদের বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছিল।