ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ৯ বছরেও ৪৫ ভাগ কাজ বাকি, যানজটে চরম ভোগান্তি
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১:২০ এএম, ১৭ জুন,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০১:৩০ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
কোথাও চলছে ড্রেন নির্মাণ কাজ, কোথাও নির্মিত হচ্ছে ফ্লাইওভার, কোথাও বিআরটিএ স্টেশন আবার কোথাও চলছে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ। উন্নয়নে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলছে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে গাজীপুর মহানগরীর শিববাড়ি পর্যন্ত। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকল্পের কাজ করছে বিআরটিএ। দীর্ঘ নয় বছর ধরে চলছে এ প্রকল্পের কাজ। এ সময়ে মধ্যে মাত্র ৫৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখনো বাকি ৪৫ ভাগ কাজ। কথা ছিল বিআরটিএর এই প্রকল্পের কাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে গাজীপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত একটি বিকল্প সড়ক নির্মাণ হবে। কিন্তু তা আজও হয়নি। ফলে টঙ্গী থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে অসহনীয় দীর্ঘ যানজট। এতে ঢাকামুখী ও উত্তরাঞ্চলগামী যাত্রীরা প্রতিদিন পড়ছেন দীর্ঘ যানজটে। নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা, পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তিতে। টঙ্গী থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ১২ কিলোমিটার অংশ শীত কিংবা গ্রীষ্ম সব সময় যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। আর এ নিয়ে যাত্রী সাধারণের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সড়কটিতে চলাচলকারীরা বলছেন, উন্নয়ন কাজের জন্য এখনই চলাচল করতে নানা সমস্যা হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় মানুষের ভোগান্তি আরও বেড়েছে। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক সচলে পুরোদমে কাজ চলছে। এরইমধ্যে প্রকল্পের ৫৫ ভাগ কাজ শেষ হয়ে গেছে। টঙ্গী কলেজ গেট থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে চার লেনের রাস্তার কাজ আগামী এক মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। ২০২২ সালের জুনে গাজীপুর-বিমানবন্দর অংশটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হবে।
মঙ্গল ও বুধবার সড়কটির বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা যায়, সড়কের বিভিন্ন অংশে পিচঢালাই উঠে গেছে। কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছে ছোট-বড় গর্ত। এসব গর্তে জমে আছে পানি। সড়কের কিনারা বা বিভাজকের মাঝখানে জমে আছে বালুর স্তূপ। সড়কের কাছে পড়ে আছে ইটের খোয়া, বালু বা বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী। এর মধ্যেই চলাচল করছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, রিকশা, অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন। পুলিশ, পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, চলমান বিআরটি প্রকল্পের ড্রেনের কাজের জন্য মহাসড়কের দুপাশে কোনো ফুটপাত নেই। ফলে লাখ লাখ শ্রমিক সকাল, দুপুর ও রাতে অফিস এবং বাড়ি ফেরার পথে মহাসড়ক ধরেই চলাচল করছেন। এতে যানবাহনের দীর্ঘ সারি হচ্ছে। প্রতিদিন রাত ১০টার পর রাজধানী ঢাকায় পণ্যবাহী ট্রাক ও লরি প্রবেশ করে। দিনের বেলায় উত্তরাঞ্চল থেকে আসা এসব পণ্যবাহী যানবাহন টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত রাস্তার পাশে অবস্থান নেয়। ফলে সড়কের এক পাশ বন্ধ থাকছে। এছাড়া জনবহুল এ এলাকার সড়ক মহাসড়কগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনুমোদনহীন ও ধীরগতির যানবাহন রাস্তায় চলে আসে। এতেও যানজটের সৃষ্টি হয়।
গাজীপুরে যানজটের জন্য বেশ কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। এ গুলো হলো- মহাসড়কের দু’পাশে কোনো ফুটপাত না থাকা, লাখ লাখ পোশাক শ্রমিকের মহাসড়কের ওপর দিয়ে যাতায়াত, রাস্তায় নির্মাণ কাজ, মহাসড়কের পাশে অবৈধ পার্কিং, ধীর গতির ও অনুমোদনহীন যানবাহন চলাচল, রাস্তা দখল করে দোকানপাট ও গণ পরিবহনের যত্রতত্র গাড়ি থামানো এবং যাত্রী ওঠা-নামা করানো। যানজটের বিষয়ে স্থানীয়রা জানান, চলমান বিআরটি প্রকল্পের কাজের জন্য রাস্তায় যানবাহন ধীর গতিতে চলাচল করছে। যার ফলে যানবাহনের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। এতে বিভিন্ন পরিবহনের চালকরা সড়কের মধ্যেই যাত্রী ওঠানামা করছে। বৃষ্টির কারণে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাময়িকভাবে সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামত করা হলেও বৃষ্টি হলে ফের রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয়রা আরও জানান, ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে টঙ্গি ব্রিজ থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত যানজটে ভোগান্তির শিকার হননি এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। চান্দনা চৌরাস্তা থেকে কোনাবাড়ী-কাশিমপুর পর্যন্ত সড়কেও যানজটে নাকাল হতে হয় সাধারণ মানুষকে। অনেক সময় যানজট ১০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়। এতে প্রতিদিন একেক জন নাগরিকের প্রায় ৮ ঘণ্টা করে সময় নষ্ট হচ্ছে। ঢাকা-গাজীপুর রুটে চলাচলকারী বলাকা পরিবহনের চালক নিয়ামত হোসেন জানান, ঢাকার গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী বাজার পর্যন্ত যেতে কখনো কখনো চার থেকে ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। অথচ এই পথ যেতে ২৫-৩০ মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সারাবছরই আমরা এ দুর্ভোগ পোহাচ্ছি। আগে গাজীপুর থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ৬ সিঙ্গেল বাস চালিয়েছি। এখন সারাদিনে দুই সিঙ্গেল বাস চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। এতে গাড়ির মালিক ও পরিবহন শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ভোগড়া বাইপাস এলাকার ব্যবসায়ী এমারত হোসেন জানান, এ সড়কের কিছুই ঠিক নেই। ফুটপাত ও সড়ক দখল করে দোকান বসছে। কোথাও কোথাও আবার বাজারও বসছে। সামান্য বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। বৃষ্টিতে রাস্তায় গর্ত সৃষ্টি হচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাওয়া রাস্তাগুলো সঠিক সময়ে সংস্কার করা হচ্ছে না। এসব কারণে এখানে যানজট লেগেই আছে। এমন একটি দিনও নেই এখানে যানজটের সৃষ্টি হয় না। গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া এলাকার বাসিন্দা আফজাল হোসেন জানান, প্রতিদিন ভোরে বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে উত্তরা পর্যন্ত যেতে কখনো কখনো তার চার ঘণ্টাও লেগে যায়। বিকেলে অফিস থেকে বের হয়ে বাসায় আসতেও একই সময় লাগে। স্থানীয়রা জানান, জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে ভোগড়া বাইপাস চৌরাস্তা পর্যন্ত যানজট যেন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ যানজটের প্রভাব পড়ছে বাইপাস চৌরাস্তা থেকে পূর্ব ও পশ্চিম দিকের গাজীপুর-সিলেট মহাসড়কেও। এই মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাকই বেশি চলাচল করে। এর বাইরে মহাসড়কের ওয়্যারলেস গেট এলাকা, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে কড্ডা পর্যন্ত, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সালনা ব্রিজ থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত যানজট নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালে গাজীপুর থেকে রাজধানীর বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কে গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের (বিআরটিএ, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) আওতায় দেশের প্রথম বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটিএ) প্রকল্প শুরু হয়। ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে মেয়াদ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর করা হয় এবং ব্যয় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬৪ কোটি ৮২ লাখ ১৪ টাকা। এরপর আরও দু’দফা প্রকল্পের সময় বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুনে শেষ করার কথা রয়েছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি এডিবি, ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি) ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির (ডিইএফ) অর্থায়ন করছে।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, বিআরটিএ সড়ক উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণ, বিআরটিএ লেন, সাতটি ফ্লাইওভার, ১৯টি বিআরটিএ স্টেশন, ২৫ কিলোমিটার ড্রেন ও দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। সাতটি ফ্লাইওভারের কোনোটির ওপর আবার কোনোটির নিচ দিয়ে বিআরটিএ বাস চলাচল করবে। আবার কোনো ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে বিআরটিএ ও গণপরিবহন একসঙ্গে চলবে। ধীরগতির যান চলাচল নিরসনে আলাদা আড়াই মিটার প্রস্থের লেন ও সাড়ে চার মিটার ফুটপাথ থাকবে বলে জানা গেছে। সূত্র আরও জানায়, এ প্রকল্পের আওতায় ১৬ কিলোমিটার অ্যাট গ্রেড ও সাড়ে ৪ কিলোমিটার এলিভেটেড মেইন করিডর নির্মাণ করা হবে। মেইন করিডরসংলগ্ন ১১৩টি বা ৫৬ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের উন্নয়ন করা হবে। বিআরটি বাস ডিপোসহ বিভিন্ন স্থানে ২০টি স্টপেজ থাকবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্পের আওতায় টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত মোট ২৮ কিলোমিটার ড্রেন ও ১০টি কাঁচাবাজার নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া ১৪০টি আটিকুলেটেড বাস ক্রয় করা হবে। এই রুটে ধীরগতির যানবাহন চলাচল করবে পৃথক লেনে। দ্রুতগতির যান চলাচলের জন্য সড়কের মাঝ বরাবর দুই লেন পৃথক করা হবে। সেখানে দ্রুত, নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থায় ঘণ্টায় ৪০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবে।
বিআরটি কর্তৃপক্ষ জানায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ এখন পুরোদমে চলছে। ২০২২ সালের জুনে গাজীপুর-বিমানবন্দর অংশটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হবে। এ রুটটি চালু হলে গণপরিবহন ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। সাড়ে ২০ কিলোমিটার পথ যেতে সর্বোচ্চ আধা-ঘণ্টা লাগবে। ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসবে। যাত্রীরা দ্রুত কর্মস্থলে পৌঁছতে পারবেন।
বিআরটি প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক (সওজ অংশ) মো. কায়সার হামিদ বলেন, এরইমধ্যে প্রকল্পের ৫৫ ভাগ কাজ শেষ হয়ে গেছে। টঙ্গী কলেজ গেট থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে চার লেনের রাস্তার কাজ আগামী এক মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। বিআরটি লেনও হয়ে যাবে। বিআরটি স্টেশনগুলোর কাজও চলছে। ফ্লাইওভারের কাজও চলমান রয়েছে। সড়কের সাইড রাস্তার কাজও চলতে থাকবে। তিনি আরও বলেন, আগামী বছরের জুন মাসে পুরো কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আশা করছি নির্ধারিত সময়েই কাজ শেষ হয়ে যাবে। সড়কের দুই পাশের ড্রেনগুলো পরিষ্কারের কাজ চলছে। ড্রেনগুলোর ময়লা পরিষ্কার হয়ে গেলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। তখন শুধু ফ্লাইওভারের কাজ চলমান থাকবে।