২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২৬-এর প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে : প্রধান উপদেষ্টা

আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে করা যেতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সোমবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। 

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমি প্রধান সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদের যদি, আবার বলছি ‘যদি’, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। 

মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়। যেকোনো সংস্কারের কাজে হাত দিতে গেলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন। এই ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া কী হবে এ বিষয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রথম বিজয় দিবস উপলক্ষে দেয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিভাবে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তা তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। 

তিনি বলেন, প্রথম পর্যায়ে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশন শিগগিরই চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করবে বলে আমি আশা করি। আমরা এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের নিয়ে একটি ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ প্রতিষ্ঠা করার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এর কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে মতামত বিনিময় করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপন হবে সেগুলো চিহ্নিত করা এবং বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা। 

তিনি বলেন, যেহেতু জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, তা বিবেচনা করে আমি এই কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করব। আমার সাথে এই কমিশনের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। কমিশন প্রয়োজন মনে করলে নতুন সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে। প্রথম এই ছয়টি কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আগামী মাসেই জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন কাজ শুরু করতে পারবে বলে আমি আশা করছি। এই নতুন কমিশনের প্রথম কাজ হবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেসব সিদ্ধান্ত জরুরি, সেসব বিষয়ে তাড়াতাড়ি ঐকমত্য সৃষ্টি করা এবং সবার সঙ্গে আলোচনা করে কোন সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায় সে ব্যাপারে পরামর্শ চূড়ান্ত করা। ভাষণে জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি সংস্কার কমিশনগুলোর কাজের অগ্রগতি, অর্থনীতি, রিজার্ভ, বাজার সিন্ডিকেট, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, দেশের বিরুদ্ধে পরাজিত শক্তির অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র, আগামী দিনের নতুন বাংলাদেশ গড়ার নানা পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। এর আগে ভাষণের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ১৬ ডিসেম্বর জাতির এক বিশেষ দিন। বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির বুক ফুলিয়ে দাঁড়াবার দিন। এই দিনে স্মরণ করি লাখ লাখ শহীদকে, অগণিত শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ জনতার আত্মত্যাগকে; যার ফলে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু আমরা সেই অর্জনকে আমাদের দোষে সম্পূর্ণতা দিতে পারিনি। সর্বশেষ এবং প্রচন্ডতম আঘাত হানল এক স্বৈরাচারী সরকার। সে প্রতিজ্ঞা করেই বসেছিল, এ দেশের মঙ্গল হতে পারে এমন কিছুই সে অবশিষ্ট থাকতে দেবে না। 

মাত্র চার মাস আগে একটি অসম্ভব সম্ভব হয়ে গেল: এ বছরের বিজয় দিবসকে বিশেষ কারণে মহাআনন্দের দিন হিসাবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মাত্র চার মাস আগে একটি অসম্ভব সম্ভব হয়ে গেল, দেশের সবাই মিলে একজোটে হুংকার দিয়ে উঠল, পৃথিবীর ঘৃণ্যতম স্বৈরাচারী শাসককে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে আমাদের প্রিয় দেশকে মুক্ত করেছে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থান। যে হাজার হাজার শহীদ এবং আহতদের আত্মত্যাগ এবং ছাত্র-জনতার অটুট ঐক্যের মাধ্যমে এই গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হলো-তাদের সবাইকে স্মরণ করি এবং এবারের মহাবিজয়ের দিনে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে তাদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানাই।

নতুন বাংলাদেশ গড়ার সংকল্পে অটুট আছি: প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যখন পরাজিত শক্তি নড়েচড়ে ওঠার চেষ্টা করছিল, তখন সব রাজনৈতিক দলের এবং সব ধর্মের শীর্ষ ব্যক্তিদের এবং ছাত্রদের সমাবেশের মাধ্যমে এককণ্ঠে সজোরে ঘোষণা দিয়েছিল আমরা যে নিরেট ঐক্যের মাধ্যমে অভ্যুত্থান করেছি সেই ঐক্য আরও জোরদার হয়েছে। চার মাসের ব্যবধানে আমাদের ঐক্য কোথাও শিথিল হয়নি। নতুন বাংলাদেশ গড়ার সংকল্পে আমরা অটুট আছি। 

নিজের লক্ষ্যকে জাতির লক্ষ্যের সঙ্গে একীভ‚ত করুন: ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পরাজিত শক্তি তাদের পরাজয় কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তারা প্রতিদিন দেশের ভেতরে এবং বাইরে থেকে জনতার অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করার জন্য বিপুল অর্থব্যয়ে নানা ভঙ্গিতে তাদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাচার করা হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের আয়ত্তে রয়েছে। তাদের সুবিধাভোগীরা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। আমাদের ঐক্য অটুট থাকলে তারা আমাদের লক্ষ্য অর্জন থেকে ব্যর্থ করতে পারবে না। 

অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সত্যই হোক হাতিয়ার: দেশের গণমাধ্যমকর্মী ও জনগণের প্রতি আহবান জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিশ্বের কাছে দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরুন। অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সত্যই হোক আমাদের হাতিয়ার।

পূর্ব তিমুরের রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত: তিনি আরও বলেন, বিজয় মাসে গণঅভ্যুত্থানকে অভিনন্দন জানাবার জন্য, আমাদের বিজয় দিবসে যোগ দেয়ার জন্য ঢাকায় এসেছেন পূর্ব তিমুরের রাষ্ট্রপতি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস হোর্তা। তিনি তার দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। 

ভিসা অফিস নিয়ে আসতে অনুরোধ করেছি: প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং ভুল তথ্য প্রচারের বিষয়েও আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক‚টনীতিকদের জানিয়েছি। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে যাদের ভিসা অফিস নয়াদিল্লিতে আছে, তাদের ঢাকা বা অন্য কোনো প্রতিবেশী দেশে ভিসা অফিস নিয়ে আসতে অনুরোধ করেছি। আমি বলেছি, ইউরোপীয় দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর ভিসা পেতে সমস্যা হয়। তারা যদি ভিসা সেন্টার ঢাকায় নিয়ে আসেন তা হলে আমাদের ছেলেমেয়েদের ভোগান্তি কমে যাবে। এছাড়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতার মাত্রা বাড়ানোর বিষয়ে আমি আলাপ করেছি। 

ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা এবং নিয়মশৃঙ্খলা ফিরে আসছে: প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে অর্থনীতি তখন ভেঙে পড়ার অবস্থায় ছিল। গত চার মাসে এই অবস্থার বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা এবং নিয়মশৃঙ্খলা ফিরে আসছে। কোনো ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হয়নি। ব্যাংক যত দুর্বলই হোক তাকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। 

তিনি বলেন, প্রথম দিকে আমানতকারীর টাকা উত্তোলনের ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। এখন সেটা তুলে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংককে আমানতকারীর আমানত ফেরত দেয়ার জন্য নতুন টাকার সরবরাহ দিতে প্রস্তুত হয়েছে। আশা করি এতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সবার আস্থা ফিরে আসবে।

শ্বেতপত্র কমিটির রিপোর্ট পড়ে মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছে: শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির ৪০০ পৃষ্ঠার বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, রিপোর্ট পড়ে দেশের মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছে। ফ্যাসিবাদী সরকার দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে দিয়ে গেছে, এটা সবাই বুঝতে পারছিল। কিন্তু অর্থনীতিকে কী পরিমাণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়ে গেছে তার পরিমাপ সম্বন্ধে কোনো ধারণা করতে পারছিল না। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি হিসাব-নিকাশ করে এর পরিমাণ বের করে দিয়েছে।

প্রকল্পের মোড়কে বিশাল অর্থ লুটপাট করেছে: তিনি আরও বলেন, রিপোর্ট পড়ে সবাই অবিশ্বাস্য চোখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। কারও মুখে কথা বের হচ্ছে না। দিনদুপুরে সবার সামনে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে পাচার করে নিয়ে গেছে। কেউ বলার ছিল না। কেউ দেখার ছিল না। যারা নিয়ে গেছে তাদেরকে কেউ বাধা দেয়নি। বরং সর্বস্তরে সবাই আগ্রহ সহকারে সহযোগিতা করেছে। কারণ তারা সব আপন লোক। বিশাল বিশাল প্রকল্প নেয়া হয়েছে ঋণের টাকায়। এসব প্রকল্পের মোড়কে বিশাল বিশাল অর্থ লুটপাট করেছে। প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে কত বেশি ব্যয় ধরে কাদের হাতে টাকাটা পাচার করে দেয়া হয়েছে তাও এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে যে, বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক টাকাই লুটপাট হয়েছে।

এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কাজ পাচারের টাকা ফিরিয়ে আনা: প্রতিবছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে হার দেখানো হয়েছে সেটাও মনগড়া মন্তব্য করে ড. ইউনূস বলেন, দেশকে এবং পৃথিবীকে বলা হচ্ছিল কী সুন্দর দেশ বাংলাদেশ-লাফিয়ে লাফিয়ে তার উন্নয়ন এগিয়ে চলছে। তিনি আরও বলেন, এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কাজ হলো পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা। তারা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে সেটা চেষ্টা করছে।

গুম কমিশনের প্রতিবেদন লোমহর্ষক: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে গুম কমিশনসহ ১৫টি কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশন পূর্ণ উদ্যমে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। গুম কমিশন গত পরশু তাদের প্রতিবেদনের প্রথম খÐ আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করে গেছে। গুমের শিকার বহু পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে এটা এখন প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এই প্রতিবেদন পড়ার আগেই আপনাদের সাবধান করে রাখি, এটি একটি লোমহর্ষক প্রতিবেদন। মানুষ মানুষের প্রতি কী পরিমাণ নৃশংস হতে পারে এতে আছে তার বিবরণ। অবিশ্বাস্য বর্ণনা। সরকারের আক্রোশের শিকার হয়ে ঘটনাচক্রে যারা এখনো বেঁচে আছেন তারা আজ পর্যন্ত মুখ খুলতে সাহস করছেন না। তাদের ভয় কিছুতেই কাটছে না। তাদের ভয়, হঠাৎ যদি ওই জালেমরা আবার ক্ষমতায় আসে তাহলে তাদের প্রতি এরা নৃশংসতম হবে। গত সরকারের ঘৃণ্যতম অধ্যায়ের ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে এই প্রতিবেদন অমর হয়ে থাকবে। 

নির্বাচন কমিশন তাদের প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছেন: ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এখন থেকে সবাই মিলে এমন একটি ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে পারি যে, স্থানীয় নির্বাচনসহ সব নির্বাচনে সব কেন্দ্রে প্রথমবারের ভোটাররা ১০০ শতাংশের কাছাকাছি সংখ্যায় ভোটদান নিশ্চিত করবে। এটা নিশ্চিত করতে পারলে ভবিষ্যতে কোনো সরকার মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার সাহস করতে পারবে না। এ সময় ভুয়া ভোটারদেরকে তালিকা থেকে বের করে দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

প্রবাসীদের ভোট দেয়া নিশ্চিত করতে চাই: তিনি আরও বলেন, এবার আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট দেয়া নিশ্চিত করতে চাই। অতীতে আমরা এ ব্যাপারে অনেকবার আশ্বাসের কথা শুনেছি। এই সরকারের আমলে এটা যেন প্রথমবারের মতো বাস্তবায়িত হয় তা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। 

আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে: ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নির্বাচন আয়োজন ও সংস্কার ছাড়াও আপনারা আমাদের ওপর অনেক দায়িত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। ফ্যাসিবাদী সরকারের কাছ থেকে আমরা বিপর্যস্ত এক অর্থনীতি পেয়েছি। আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের মাসের তুলনায় ১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। সামগ্রিকভাবে, ২০২৪ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়কালে রফতানি ১৬ দশমিক ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। গত বছর একই সময়ে রফতানি আয় ছিল ১৪.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বছরের হিসাবে এই প্রান্তিকে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এসবের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। 

মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমে আসবে: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সাফল্য এখনো পাইনি। তবে আমার বিশ্বাস, মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমে আসবে। পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এখনো পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। এটা সম্ভব হলে আমরা আশা করি জিনিসপত্রের দাম আরও কমে আসবে। আমরা আপনাদের কষ্টে সমব্যথী। তবে আমরা জানি সরকারের কাজ কেবল সমবেদনা জানানো নয়। আমরা আপনাদের কষ্ট কমিয়ে আনতে সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সবার সহযোগিতা চাই: বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে বিকল্প কৃষিবাজার চালু করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সবার সহযোগিতা চাই। আমরা ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাদের কাছে ওয়াদা করেছে বাজারে পণ্য সরবরাহের কোনো সংকট হবে না। 

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করব: ড. ইউনূস বলেন, হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত পতিত স্বৈরশাসক ও তার দোসরদের বিচার কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। এজন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য আসামিদের বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সব ধরনের সুযোগ তারা পাবেন। বিচার প্রক্রিয়া সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও অন্য পর্যবেক্ষকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। বিচারের যে কোনো অংশ চাইলে যে কেউ রেকর্ড করার সুযোগ পাবেন। 

এই বিজয়ের মাসে দল-মত, জাতি-ধর্ম, বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, শক্তিশালী স্বৈরাচারী সরকারকে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমেই হটাতে পেরেছি। তবে তারা এখনো সর্বশক্তি দিয়ে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যকে নস্যাৎ করতে চাচ্ছে, একের প্রতি অন্যের বিষ উগড়ে দিতে চাচ্ছে। তাদের এই হীন প্রচেষ্টাকে কোনোভাবেই সফল হতে দেবেন না। এটা আমাদের বিজয়ের মাস। 

তিনি আরও বলেন, বিজয়ের মাস হোক নাগরিকদের পরস্পরের মধ্যকার সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ভয়বিহীন থাকবে এমন এক সমাজ গড়ার মাস- সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভয়ে ভীত হতে হবে না, নারীকে পুরুষের ভয়ে ভীত হতে হবে না, বিত্তহীনকে বিত্তবানদের ভয়ে ভীত হতে হবে না, নিজের মতপ্রকাশে কারও ভয়ে ভীত হতে হবে না। বিজয়ের মাস হোক অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রতিজ্ঞা নেয়ার মাস।