তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডাক্তার মুরাদকে মঙ্গলবারের মধ্যে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার নির্দেশ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৪৪ এএম, ৭ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১২:২৫ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডাক্তার মুরাদ হাসান সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসৌজন্যমূলক বক্তব্য দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মঙ্গলবারের মধ্যে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আজ সোমবার রাতে তার বাসভবনে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান।
ওবায়দুল কাদের বলেন, আজ সন্ধ্যায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে এবং আমি আজ রাত ৮ টায় প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে বার্তাটি পৌঁছে দিই।
এর আগে, বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারের এক সদস্যকে নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের ‘নারীবিদ্বেষী’ বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে ফাঁস হয়েছে একটি ফোনালাপ। দাবি করা হচ্ছে, এই কথোপকথনটি ডা. মুরাদ হাসান ও চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির। ফোনালাপে থাকা চিত্রনায়ক ইমন ইতোমধ্যে সেটি স্বীকারও করেছেন। ফাঁস হওয়া ওই কথোপকথনে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মাহিকে ধর্ষণের হুমকি দেয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় তুলে আনার হুমকি দেন। পুরো বক্তব্যে ‘অশ্রাব্য’ কিছু শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। তবে এ নিয়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রী কিংবা মাহিয়া মাহির সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে, এরকম একটি পদে আসীন যেকোনো ব্যক্তির এ ধরনের ফোনালাপ প্রকাশ পাওয়ার পরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না।
এর আগে নানাভাবে এই প্রতিমন্ত্রী আলোচনায় আসেন। শনিবার বেসরকারি একটি টেলিভিশনের টক শোতে প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান অপর আলোচক বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়ার সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রী পাপিয়াকে ‘মানসিক রোগে আক্রান্ত’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি নিজে একজন ‘চিকিৎসক হিসেবে’ বিএনপির এই নেত্রীর (পাপিয়া) ‘চিকিৎসা দরকার’ মনে করেন বলেও মন্তব্য করেন। এ সময় দু’জনের মধ্যে তীব্র বাগবিতন্ডা হয়।
এর দুদিন আগেই ইউটিউবে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারের এক নারী সদস্যকে উদ্দেশ্য করে অশালীন বক্তব্য দেন ডা. মুরাদ হাসান। প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যায়, অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের এক প্রশ্নের জবাবে হাস্যরস করতে করতে ওই নারীকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেন তিনি। এসময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়েও ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করতে শোনা যায় তথ্য প্রতিমন্ত্রীকে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। বিএনপির পক্ষ থেকেও এ ধরনের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তার পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে।
এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই ফোনালাপটি ফাঁস হয়। ফোনালাপের শুরুতে ডা. মুরাদের দাবি করা কণ্ঠের অন্য পাশে চিত্রনায়ক ইমনকে কথা বলতে শোনা যায়। চিত্রনায়ক ইমন ডা. মুরাদকে জানান, তিনি বনানীর একটি রেস্তোরাঁয় রয়েছেন। কথা বলার একপর্যায়ে মাহিয়া মাহিও তার সঙ্গে রয়েছেন জানিয়ে ইমন ডা. মুরাদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন।
ডা. মুরাদ মাহিয়া মাহিকে ফোনে পেয়ে বিভিন্ন অশ্লীল কথাবার্তা বলতে থাকেন। একপর্যায়ে ‘অশ্লীল ভাষায়’ দেখা করার জন্য ‘নির্দেশ’ দেন। প্রয়োজনে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাঠানোরও হুমকি দেন তিনি। ওই কথোপকথনের দ্বিতীয় ধাপে আবার কথা হয় এই দুজনের। ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপটি ‘সঠিক’ বলে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে স্বীকার করেছেন চিত্রনায়ক ইমন। ঘটনাটি দুই বছর আগের দাবি করে ইমন জানান, একটি ছবির মহরত অনুষ্ঠানের আগের রাতে ফোন দেন প্রতিমন্ত্রী।
ইমন বলেন, ডিরেক্টর সুমন ভাইসহ (ওয়াজেদ আলী সুমন) আমরা মিটিং করছিলাম। তখন উনি (প্রতিমন্ত্রী) হঠাৎ ফোন দিয়েছেন। তিনি কিন্তু প্রথমেই বলেছেন, ‘তুই ফোন ধরস নাই কেন?’ পরে উনিই আবার ফোন দিয়েছেন। এটা ২০২০ সালের করোনারও আগের ঘটনা। একজন মন্ত্রী বারবার ফোন দিচ্ছেন, আমি কিন্তু বলেছি, ‘হ্যাঁ, ভাই আসতেছি। দেখছি ভাই’। তথ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ডা. মুরাদ যেকোনো আর্টিস্টকে ফোন দিতেই পারেন উল্লেখ করলেও চিত্রনায়ক ইমন মনে করেন, ‘এমন আচরণ অগ্রহণযোগ্য।’ তবে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, তিনি নিজে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছেন মাত্র।
এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে সম্ভব হয়নি। এদিকে মাহিকে বারবার ফোন করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
প্রতিমন্ত্রীর কথোপকথন সহজভাবে নিতে পারছেন না দেশের শোবিজ অঙ্গনের মানুষেরা
প্রতিমন্ত্রী মুরাদের ফোনালাপ সোশ্যাল মিডিয়া ফাঁস হয়েছে। একজন চিত্রনায়িকার সঙ্গে প্রকাশিত ওই ফোনালাপে প্রতিমন্ত্রীর কথোপকথন সহজভাবে নিতে পারছেন না দেশের শোবিজ অঙ্গনের মানুষেরা। বিষয়টি নিয়ে শোবিজ অঙ্গনে নানাভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিনয়শিল্পী, গায়ক-গায়িকা ও নির্মাতারা।
তথ্যপ্রতিমন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। নারীর প্রতি ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য করে বেশ তোপের মুখে পড়েছেন তথ্যপ্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানও। এরই মধ্যে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে দুটি ফোনালাপ রেকর্ড ফাঁস হয়েছে।
সোমবার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘আগের দিন দেখলাম প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নাতনিকে নিয়ে অশ্লীলতম ভাষায় প্রজাতন্ত্রের একজন চাকর কথা বললেন। তার পরদিন সেই একই লোক এক অনুষ্ঠানে গিয়ে পুলিশ ভাইদের নসিহত করলেন যাতে তারা কারও সঙ্গে ব্যবহার খারাপ না করেন। তার পরদিন শুনলাম উনি রেপ করার থ্রেট দিচ্ছেন কাউকে। এখন আপনারাই বলেন, এমন দেশটি কোথায় খুঁজে পাবেন?’
ক্ষোভ প্রকাশ করে ফারুকী লেখেন, ‘এইসব দেখিয়া শুনিয়া একজন নাগরিক হিসাবে আমি যার পর নাই ক্ষুব্ধ।’
খ্যাতিমান এ নির্মাতা মনে করছেন, মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা এখন মুরাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসতে লজ্জা বোধ করবেন। এই ছোট্ট জীবনে আমার সুযোগ হইছে দুয়েকজন মন্ত্রী দেখার। আমি বিশ্বাস করি তারা কেউই চাইবেন না এই লোক তাদের বিজ্ঞাপন হয়ে উঠুক।
অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন কলরেকর্ডটি কুৎসিত আখ্যা দিয়েছেন। তিনি নিজের ফেসবুক হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘বৃষ্টিভেজা সুন্দর এই সকালটা শুরু হলো কুৎসিত এক কলরেকর্ড শুনে!’
নির্মাতা শিহাব শাহীন লিখেছেন, ‘সে একাধিকবার না বলেছিল।’
জনপ্রিয় রম্য লেখক শিমু নাসের লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ এমপি ও প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান নিজেকে বাঁচাতে পারেন একটা উপায়ে। তিনি ঘোষণা দিবেন, দলে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে শুধু সেই, যে ক্ষমতায় এসে আমার মতো কখনো ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করেনি।
কণ্ঠশিল্পী নাজমুন মুনিরা ন্যান্সি লিখেছেন, ‘এমন বিকৃত রুচি, বিকৃত ভাষার মানুষ আমাদের বর্তমান সরকারের প্রতিমন্ত্রী! রাজনীতির ময়দানে পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে সস্তা পাবলিসিটির জন্য যে লোক একজন নারীকে সম্মান দিতে জানে না তাকে ধিক্কার জানাই। জাইমা রহমানকে নিয়ে করা এমন জঘন্য বানোয়াট বক্তব্য প্রত্যাহারে সরকার কি ভূমিকা পালন করেন তা দেখার অপেক্ষায় বাঙালি জাতি।’
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একজন নেতার কন্যাকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করার অভিযোগে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. মুরাদ হাসানকে নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ঠিক এমন সময়েই ফোনালাপ ফাঁসের বিষয়টি সামনে এলো।
তার এমন বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান ভার্চুয়াল আলোচনায় নারীবিদ্বেষমূলক যে বক্তব্য দিয়েছেন তা তার ব্যক্তিগত মত। দলের বক্তব্য না। এরপর ওবায়দুল কাদের বলেন, আজ সন্ধ্যায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে, তাকে মঙ্গলবারের মধ্যে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন।