কিয়েভকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে চান পুতিন?
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৩:০০ এএম, ১৩ মার্চ,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:০৬ এএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখলে রুশ সামরিক বাহিনী পুরোমাত্রার আক্রমণ শুরু করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই ধারণা জোরালো হয়েছে, কিয়েভের আশপাশের এলাকায় শনিবার রুশ সৈন্যদের সঙ্গে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর লড়াইয়ের তীব্রতা ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায়। রাশিয়ার সৈন্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই এখন রাজধানী কিয়েভের উপকণ্ঠে রয়েছে বলে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। গত ১৭ দিন ধরে কিয়েভের কাছের যুদ্ধ পরিমাপ করা হচ্ছে মাইলের হিসাবে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য এখন কিয়েভের কেন্দ্র থেকে ১৫ মাইল দূরে রয়েছেন। তবে রুশ সৈন্যরা কিয়েভের উত্তর-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে অগ্রসর হওয়ার সময় ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ছে। ইউক্রেনের পদাতিক বাহিনী ড্রোনের মাধ্যমে পশ্চিমাদের সরবরাহ করা ট্যাঙ্ক-বিরোধী অস্ত্র ব্যবহার করছে। দেশপ্রেমিক স্থানীয় জনগণের কাছে থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করে রুশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে ইউক্রেনের সৈন্যরা। কিয়েভ অভিমুখে অগ্রসর হতে গিয়ে রাশিয়ার সৈন্যরা ট্যাংকের জ্বালানি এবং অন্যান্য সরঞ্জামের ঘাটতির মুখোমুখি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে ইউক্রেনে চলছে রাশিয়ার তীব্র (টশৎধরহব জঁংংরধ ডধৎ) আক্রমণ। গত রবিবার থেকে রুশ বাহিনী সেই দেশের কেন্দ্রীয় এলাকা, উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের শহরগুলোতে তাদের গোলাবর্ষণ বাড়িয়েছে। সূর্যাস্তের পর থেকেই কিয়েভ (কুরা), চেরনিহিভ (ঈযবৎহরযরা), মাইকোলাইভ (গুশড়ষধরা) এবং খারকিভে (কযধৎশরা) ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হচ্ছে। দেশজুড়ে এখন শুধু ধ্বংসের দৃশ, আর ভিটেমাটি হারানোর হাহাকার। ইউক্রেনীয় সৈন্যরা, রুশ আক্রমণ থেকে তাদের অসামরিক নাগরিকদের যতটা সম্ভব রক্ষা করার চেষ্টা করছে, যাদের সেই সৌভাগ্য হয়নি, তারা রাস্তাতেই মৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদের দেশ ইউক্রেন এখন ধ্বংসস্তূপ : বিশ্বের প্রায় সব পত্রিকায় মূল খবর ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন। ইউক্রেন দাবি করছে, তারা ১১ হাজার রুশ সেনা হত্যা করেছে, ১১ দিন চেষ্টা করেও রুশ বাহিনী তাদের দেশ দখল করতে পারেনি। তবে, সার্বিকভাবে দেশটি যে যুদ্ধবিধ্বস্ত, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ইউক্রেন প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধিশালী দেশ। অনেক বিশ্লেষক ভাবছেন, ইউক্রেন হামলার নেপথ্যে অনেক কারণের মাঝে এটিও একটি বড় কারণ হতে পারে। প্রাকৃতিক সম্পদে ইউক্রেন বেশ সমৃদ্ধ। দেশটিতে রয়েছে কয়লা, লোহা, প্রাকৃতিক গ্যাস, ম্যাঙ্গানিজ, খনিজ লবণ, তেল, গ্রাফাইট, সালফার, কাওলিন, টাইটানিয়াম, লিথিয়াম, নিকেল, ম্যাগনেসিয়াম, কাঠ, পারদসহ বিভিন্ন উপাদান। ইউক্রেনে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সরকারি ওয়েবসাইট ইউক্রেন ইনভেস্ট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশটি প্রায় ১১৭ ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। প্রায় ৮ হাজার ৭৬১টি গুরুত্বপূর্ণ খনি আছে ইউক্রেনে। দেশটি তাদের খনিজ শিল্প থেকে বছরে প্রায় ১৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা) আয় করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউক্রেন সরকার খনিজ উত্তোলনের অনুমতি দেয়ার প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উন্নয়ন করেছে। এখন খুব সহজেই উদ্যোক্তারা খনিজ সম্পদ আহরণের অনুমতি পেতে পারেন। ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাস সঞ্চয় রয়েছে ইউক্রেনের। দেশটির মাটির নিচে ১ দশমিক শূন্য ৯ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস আছে। শুধুমাত্র নরওয়েতে তাদের চেয়ে বেশি, ১ দশমিক ৫৩ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, বিপুল পরিমাণ গ্যাস সঞ্চিত থাকার পরেও দেশটি গ্যাস আমদানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। সোভিয়েত আমলে ইউক্রেনের বদলে সাইবেরিয়া থেকে বড় আকারে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়। যে কারণে এখনও ইউক্রেনের এ প্রাকৃতিক সম্পদ অক্ষত রয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিজনেস টুডের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে রাশিয়া ইউরোপের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে। এ কাজে ব্যবহার হয় নর্ড স্ট্রিম ১ পাইপলাইন এবং ইউক্রেনের নিজস্ব পাইপলাইন। জার্মানির ৫৫ শতাংশ গ্যাসের যোগানদাতা রাশিয়া। যার একটি বড় অংশ ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে যায়। এই ট্রানজিট ফি বাবদ বছরে ৭ বিলিয়ন ডলার আয় করে ইউক্রেন। এই আয় ইউক্রেনের জিডিপির ৪ শতাংশ। ইউক্রেন নিজস্ব গ্যাসের উত্তোলন শুরু না করলেও সার্বিকভাবে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহে এখনও ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই গুরুত্ব ততদিন থাকবে যতদিন আলোচিত নর্ড স্ট্রিম ২ পুরোপুরি চালু না হচ্ছে। নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইন এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল না হয়েও জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে রাশিয়া সরাসরি গ্যাস সরবরাহ করতে পারে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর জার্মানির চ্যান্সেলর নর্ড স্ট্রিম ২ এর অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়া স্থগিত করেছেন এবং অদূর ভবিষ্যতে এই পাইপলাইন চালু হওয়ার সম্ভাবনা কম। ইউক্রেনের বিতর্কিত ডনবাস অঞ্চলে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। যার কারণে এ অঞ্চলটি ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ইউক্রেনের লিথিয়াম খনিগুলো মূলত জাপোরিঝঝিয়া (ক্রুতা ব্যালকা অঞ্চল), দোনেৎস্ক (শেভচেনকিভস্কে খনি) এবং কিরোভোহরাদে (ডোবরা এলাকার পোলোখিভস্কি খনি) অবস্থিত। তবে এ অঞ্চলে এখন কোনো ধরনের খনন চলছে না। চীনের চেংজিন লিথিয়াম ও অস্ট্রেলিয়ার শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান ইউরোপিয়ান লিথিয়াম এ অঞ্চলের লিথিয়াম খননকাজের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য নিলাম লড়ছে। আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও নিলামে অংশ নিতে পারে। নিলামের বিজয়ী ঘোষণার আগেই দোনেৎস্ককে স্বাধীন দেশের মর্যাদা দিয়ে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে রাশিয়া। ইলেকট্রিক গাড়িতে ব্যবহৃত ব্যাটারির অন্যতম প্রধান উপকরণ লিথিয়াম। চাহিদা বাড়তে থাকায় বেশিরভাগ গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হন্যে হয়ে লিথিয়ামের উৎস খুঁজে বেড়াচ্ছে। বিশ্লেষকদের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ২০ শতাংশ বা তারচেয়েও বেশি টাইটানিয়ামের সঞ্চয় রয়েছে ইউক্রেনে। একইসঙ্গে ইউক্রেন হচ্ছে বিশ্বের অল্প কিছু দেশের অন্যতম, যেখানে পূর্ণাঙ্গ টাইটানিয়াম শিল্প গড়ে উঠেছে। এই শিল্পের কার্যক্রমের মধ্যে আছে খনন কাজ, পরিশোধন এবং টাইটানিয়ামভিত্তিক পণ্য উৎপাদনকারীদের কাছে টাইটানিয়ামের আকরিক পৌঁছে দেওয়া। ২০২১ সালে ইউক্রেন থেকে টাইটানিয়াম আমদানির দিক দিয়ে প্রথম ৩টি দেশ ছিল যথাক্রমে চীন, রাশিয়া ও তুরস্ক। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন যদি দীর্ঘদিন ধরে চলে, তাহলে উড়োজাহাজ খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আধুনিক উড়োজাহাজ নির্মাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ টাইটানিয়াম। গত ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং এক বিবৃতিতে জানায়, ইউক্রেন নিয়ে ধোঁয়াশায় তাদের ব্যবসায় প্রতিকুল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বোয়িং এর প্রতিনিধি জানান, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে টাইটানিয়ামের সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘিœত হতে পারে। যার প্রভাব পড়বে উড়োজাহাজ নির্মাণের ওপর। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বোয়িং টাইটানিয়ামের বিকল্প উৎস খোঁজার চেষ্টা করে। তবে এখনো বোয়িং এবং অন্যান্য উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় টাইটানিয়াম নির্মাতা রুশ প্রতিষ্ঠান ভিএসএমপিও-এভিসমার ওপর নির্ভরশীল।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নিঃসন্দেহে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী করার জন্য ইউক্রেনকে নিজেদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন রাখার চেষ্টা করবে। সেই চিন্তা থেকেই হয়তো ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া কিংবা পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর শক্তি বাড়ানোর মতো বিষয়গুলো তাদের বিবেচনায় এসেছে। যদি রাশিয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে সার্বিকভাবে এ অঞ্চলে তাদের আধিপত্য ও প্রভাব আরও বাড়বে। অপরদিকে, ইউক্রেন মার্কিন সহায়তা পেলে এবং তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারলে এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। ইউক্রেনের পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে ঝুঁকে যাওয়ার বিষয়টি রাশিয়া কখনোই ভালো চোখে দেখেনি এবং এর পেছনে ইউক্রেনের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যও নিঃসন্দেহে বড় একটি কারণ। ইউরোপ বর্তমানে অনেকাংশেই রাশিয়া থেকে আসা প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চললে এ বিষয়টি অবশ্যই সামনে আসবে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প জ্বালানি হিসেবে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের ওপর জোর দিলেও এর অপেক্ষাকৃত উচ্চমূল্য এই পরিকল্পনার গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব অ্যান্থনি ব্লিংকেনের ভাষায়, 'উষ্ণতার অস্ত্রায়ন' বা শীতের মাসে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে পুরো ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখার রুশ প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করা তাদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য। জীবাশ্ম জ্বালানির কোনো উৎসই চিরস্থায়ী নয় এবং রাশিয়াকে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে হবে। তারা কখনোই চাইবে না, প্রতিবেশী ইউক্রেনের ওপর থেকে তাদের প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ চলে যাক। সব মিলিয়ে, ইউক্রেনের সুবিশাল ও অক্ষত প্রাকৃতিক সম্পদের সঞ্চয় বর্তমান সংঘর্ষের একটি অন্যতম প্রধান নিয়ামক। দেশটির ওপর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা রাশিয়া—যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, দীর্ঘ মেয়াদে সেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা এবং কৌশলগত অবস্থানের দিক দিয়ে বাকিদের থেকে এগিয়ে থাকবে।
সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স।