ডব্লিউএইচওর মতে, দেশে ৮৫ শতাংশ মায়েরই স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করার কথা
বেসরকারি হাসপাতালে ৮৪ শতাংশ নবজাতকের জন্ম অস্ত্রোপচারে
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২:৩০ এএম, ২৯ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:০৭ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানার দক্ষিণ কাশীপুর গ্রামের বাসিন্দা সৌদিপ্রবাসী মাঈনুদ্দীন রাসেল। সম্প্রতি তিনি সন্তানসম্ভবা স্ত্রী রেনু আক্তারকে চট্টগ্রামের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করেন। ভর্তির পর জানতে পারেন, যে চিকিৎসকের অধীনে তার স্ত্রীকে ভর্তি করা হয়েছে তিনি থাকেন ঢাকায়। তার কাছে কাগজপত্র পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই চিকিৎসক সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে এসে ডেলিভারি করাবেন। সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় ভর্তি হলেও দুদিন পর এক বিকেলে ওই চিকিৎসক এসে রেনুর কাগজপত্র দেখেন। তখন তিনি জানান, রেনুর গর্ভজাত সন্তানের নড়াচড়া কম। দ্রুত অস্ত্রোপচারের (সিজারিয়ান) মাধ্যমে ডেলিভারি করাতে হবে। এ জন্য তাকে (অপারেশন থিয়েটার-ওটি, কেবিন ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বাদে) ৩৫ হাজার টাকা দিতে হবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত না জানালে সন্তান ও মায়ের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। এ কথা শুনে স্ত্রীকে অস্ত্রোপচার করাতে রাজি হন মাঈনুদ্দীন রাসেল। এ সময় টাকা জোগাড় করতে বাইরে যান তিনি। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে রেনুকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ফিরে এসে তাকে না জানিয়ে কেন ওটিতে নেয়া হলো জানতে চাইলে চিকিৎসকের এক সহকারী রোগীকে ওটি থেকে বের করে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার ‘হুমকি’ দেন। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ওই প্রবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, চিকিৎসকের দাবি করা ৩৫ হাজার টাকাসহ তার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। লাখ টাকা খরচ হয়েছে তাতে দুঃখ নেই, তবে চিকিৎসকসহ অন্যদের ব্যবহার যে একেবারেই বাণিজ্যিক, এ বিষয় কষ্ট দিয়েছে তাকে। এছাড়া তার স্ত্রীর অস্ত্রোপচার করাটা জরুরি ছিল কি না তা নিয়েও সন্দিহান তিনি। রোগীর অস্ত্রোপচারের আগে ন্যূনতম কাউন্সেলিংও করা হয়নি বলে জানান রাসেল।
বেসরকারি হাসপাতালে নরমালের পরিবর্তে সিজারিয়ান ডেলিভারি করিয়ে পকেট থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা শুধু এটি নয়, রাসেলের মতোই এমন অভিজ্ঞতা দেশের হাজারো পরিবারের। রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অধিকাংশ সন্তান প্রসব হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ও বাংলাদেশ ম্যাটারন্যাল সার্ভের সর্বশেষ তথ্যানুসারে, দেশে প্রতি বছর আনুমানিক ৩৫ লাখ নবজাতক শিশু জন্মগ্রহণ করে। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশের বেশি নবজাতকের জন্ম অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, একটি দেশে প্রতি বছর যত সংখ্যক মায়েরা সন্তান প্রসব করেন, তার ১০-১৫ শতাংশ করা যায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। বাকি ৮৫ ভাগ স্বাভাবিকভাবেই প্রসব করার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এ চিত্র ভয়াবহ। প্রতি বছর অপ্রয়োজনীয় এ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়া হচ্ছে। দেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মোট জন্ম নেয়া নবজাতকের মধ্যে ৪৭-৪৮ শতাংশের জন্ম বিভিন্ন হাসপাতালে। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ১২-১৫ শতাংশ, ৪-৫ শতাংশ এনজিও হাসপাতালে এবং বাকি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ডেলিভারি হয় বেসরকারি হাসপাতালে, যা ৮৪ শতাংশ।
সেভ দ্য চিলড্রেনে কর্মরত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. ইশতিয়াক মান্নান জানান, গত ২০ বছরে ফ্যাসিলিটি ডেলিভারি অর্থাৎ হাসপাতালে সন্তানসম্ভবা মায়েদের ডেলিভারি যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদান। সেভ দ্য চিলড্রেনের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে ড. ইশতিয়াক মান্নান বলেন, দেশে যত সিজারিয়ান হচ্ছে তার প্রায় ৭৫ শতাংশই অপ্রয়োজনীয়। তিনি বলেন, একটি দেশে ১০-১৫ শতাংশ মায়ের জন্য অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করা আদর্শিক এবং জীবন রক্ষাকারী। এর বেশি হলেই তা আদর্শিক নয়। ড. ইশতিয়াক বলেন, একটি দেশে সুষ্ঠুভাবে সন্তান ডেলিভারির সঙ্গে মাতৃমৃত্যু হার জড়িত। বর্তমানে প্রতি লাখ জীবিত নবজাতক শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে দেশে ১৯৪ জন, মতান্তরে ১৭০ জন মায়ের মৃত্যু হয়। বিশ্বের যেসব দেশে বেশি মাতৃমৃত্যু, তার তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু হার ৭০-এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণের অগ্রযাত্রা খুব মন্থর বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে বেসরকারি হাসপাতালে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার বেশি হলেও সরকারি হাসপাতালে তা আগের তুলনায় কম। বিশেষ করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীন মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বাভাবিক ডেলিভারিই বেশি। করোনাকালে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমসিএইচি-সার্ভিসেস) ও লাইন ডিরেক্টর (এমসি-আরএইচ) ডা. মোহাম্মদ শরীফ জানান, ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মোট এক লাখ ৮৭ হাজার ৭০টি নবজাতক শিশুর জন্ম হয়। তার মধ্যে এক লাখ ৭৮ হাজার ৩৭৫ জন নরমাল ডেলিভারি, আট হাজার ৪৬১ জন সিজারিয়ান এবং ২৩৪ জন ফরসেপ ও ভ্যাকুয়াম ব্রিচ প্রক্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করে। একইভাবে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক লাখ ৭২ হাজার চারজন নবজাতকের জন্ম হয়। তাদের মধ্যে এক লাখ ৬৬ হাজার ৬১৯ জন নরমাল ডেলিভারি, পাঁচ হাজার ১৬ জন সিজারিয়ান এবং ৩৬৯ জন ফরসেপ ও ভ্যাকুয়াম ব্রিচ প্রক্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, বিশ্বের অন্যান্য দেশে মিডওয়াইফরাই ডেলিভারি করানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে মিডওয়াইফের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। চিকিৎসকরা বলেন, স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসবের জন্য যেটুকু সময় অপেক্ষা করা দরকার (রোগীভেদে ৮-১৪ ঘন্টা) চিকিৎসকরা তা করেন না। তবে মহামারির সময় করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকরা নরমাল ডেলিভারি করাতেই চেষ্টা করেছেন। ফলে এ সময় কমেছে সিজারিয়ানের সংখ্যা। তবে এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, দুই বছর আগে ‘স্টপ আননেসেসারি সিজারিয়ান (সি সেকশন)’ শীর্ষক প্রচারাভিযান শুরু করে সেভ দ্য চিলড্রেন। এছাড়া এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলিজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) নেতারা বিভিন্ন ফোরামে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের তথ্য তুলে প্রচারণা চালান। অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান বন্ধে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) পক্ষ থেকে আদালতে রিট করা হয়। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আদালতের নির্দেশে সরকারের পক্ষ থেকে ন্যাশনাল টাস্কফোর্স গঠন ও ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন জমা দেয়া হয়। কিন্তু মহামারির কারণে এ বিষয়ের ওপর আর পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়নি। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বন্ধে হাইকোর্টের মাধ্যমে আইন বা বিধিমালা হলে তা বন্ধ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে নরমাল ও সিজারিয়ান ডেলিভারির বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য দেননি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমএন্ডসি অ্যান্ড এএইচ) ডা. মোহাম্মদ শামসুল। তিনি দাবি করেন, এ ধরনের সব সেবা সারাদেশে সুষ্ঠুভাবে চলছে।