ছাত্র আন্দোলনের নেতা থেকে দেশের সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৫:৩০ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০১:১০ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
এক দশক আগের কথা। ২৫ বছর বয়সী এক তরুণকে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর রাস্তায় বিভিন্ন ছাত্র বিক্ষোভে দেখা যেত তখন। বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করতেন তিনি। মাথায় লম্বা চুল আর মুখে ছিল দাড়ি। মাইক হাতে নিয়ে সবার জন্য বিনা মূল্যে শিক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানাতেন ওই তরুণ নেতা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ তরুণ এবার দেশের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন। তিনি হলেন গ্যাব্রিয়েল বোরিক। চিলির সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগামী মার্চে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন তিনি।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গ্যাব্রিয়েল বোরিকের জন্ম ১৯৮৬ সালে চিলির পুন্তা অ্যারেনাস এলাকায়। তাঁর বাবা ক্রোয়েশিয়ান এবং মা কাতালান নাগরিক। চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ২০১১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ফেডারেশনে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন বোরিক। তবে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। ২০১৩ সালে চিলির কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয় পান বোরিক এবং দুই মেয়াদে ডেপুটি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে অটোনমিস্ট মুভমেন্ট গড়ে তোলেন বোরিক। ২০১৮ সালে নিজের দলকে সোশ্যাল কনভারজেন্স পার্টির সঙ্গে একীভূত করেন। এরপর ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন তিনি।
২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাথমিক পর্বে দানিয়েল ইয়াদুয়ের বিরুদ্ধে জয় পান তরুণ নেতা বোরিক। ২০২১ সালের নভেম্বরে প্রথম দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন তিনি। উগ্র ডানপন্থী হোসে অ্যান্তোনিও কাস্ত প্রথম হন। কাস্তের চেয়ে ২ শতাংশ ভোটে পিছিয়ে ছিলেন বোরিক। ১৯ ডিসেম্বর এ দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফার ভোট হয়।
এ নির্বাচনে ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন সাবেক ছাত্রনেতা বোরিক। আর কাস্তর জুটেছে ৪৪ শতাংশ ভোট। দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে রাজধানী সান্তিয়াগো ছাড়াও গ্রাম্য এলাকাগুলোতেও বিপুল সমর্থন পান বোরিক।
চিলি হলো দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার প্রথম দেশ, যারা স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য থেকে বের হয়ে এসেছে। ১৯৭০ সালে সালভাদর আইয়েন্দে নির্বাচিত হওয়ার পর চিলিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তিন বছর পর অগুস্তো পিনোশের অভ্যুত্থানের পর সেনাশাসনের শুরু। অঞ্চলজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তবাজার অর্থনীতি। সে মডেল অনুসরণ করেই তাঁর উত্তরসূরিরাও দেশ চালাচ্ছেন।
দ্য টাইমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পিনোশে যে অর্থনৈতিক মডেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হতো না। সরকারি বিভিন্ন সেবা ও প্রাকৃতিক সম্পদ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এ অর্থনৈতিক মডেল প্রতিষ্ঠার পর চিলি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বর্গে পরিণত হয়েছিল। দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছিল চিলি। তবে দেশটিতে ক্রমাগত বৈষম্য বাড়ছিল। জীবনযাপনের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিল চিলির দরিদ্র জনগণ। চিলির জাতীয় পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি দশ পরিবারের মধ্যে ছয় পরিবারেরই মাসিক আয় দিয়ে সারা মাসের খরচ জোটে না। এমন অবস্থায় ২০১৯ সালে তুমুল বিক্ষোভে নামে জনগণ। এক মাস ধরে সরকারবিরোধী এ বিক্ষোভ চলে।
বোরিক চান চিলির অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে। অগুস্তো পিনোশের শাসনপদ্ধতি থেকে দেশকে চিরতরে বের করে নিয়ে আসতে চান তিনি। শুরু থেকেই পিনোশের অর্থনৈতিক মডেলের সংস্কারের পক্ষে কথা বলে আসছেন তিনি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থিতা পাওয়ার পরও এ নিয়ে সুর চড়া করেছিলেন বোরিক। তিনি বলেছিলেন, ‘নব্য উদারবাদের জন্মস্থল হলো চিলি, এর সমাধিস্থলও এখানেই হবে।’
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেনশন আগের চেয়ে বেশি দেওয়া, চাকরিজীবীদের সপ্তাহের শ্রমঘণ্টা (৪৫ থেকে কমিয়ে ৪০ ঘণ্টা) কমিয়ে আনাসহ নানা উদ্যোগের কারণে ভোটাররা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকতে পারেন।
গার্ডিয়ানের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর চিলিকে ঐক্যবদ্ধ করার শপথ নিয়েছেন গ্যাব্রিয়েল বোরিক। সুবিধাভোগী গুটিকয় মানুষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনেরও অঙ্গীকার করেছেন নবনির্বাচিত এ প্রেসিডেন্ট। গ্যাব্রিয়েল বোরিক বলেছেন, তিনি চিলির সব জনগণের প্রেসিডেন্ট হবেন এবং সবার জন্যই কাজ করবেন।
আগামী ১১ মার্চ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন বোরিক। তিনি বলেন, চিলির সমাজব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনার সময় হয়েছে। প্রজন্ম চায় তাদের সবার অধিকারকে সম্মান জানানো হোক। তাদের যেন ভোগ্যপণ্য কিংবা ব্যবসায়িক হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা না করা হয়।
গত রোববার জয় নিশ্চিত হওয়ার পর বোরিক বলেন, ‘আমি জানি, দেশের ভবিষ্যৎ হুমকির মধ্যে আছে। আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে গণতন্ত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করব। একে বিপন্ন করব না। আমি এমন এক প্রেসিডেন্ট হব, যে কিনা নিজে বলার চেয়ে জনগণের কথা বেশি শুনবে, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাইবে, জনগণের দৈনন্দিন প্রয়োজনগুলো মেটাবে। আমি এমন প্রেসিডেন্ট হব, যে কিনা গুটিকয় সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে কঠোর লড়াই চালাবে, যে প্রতিদিন চিলির জনগণের কল্যাণে কাজ করবে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতিও পুনর্ব্যক্ত করেছেন বোরিক। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কপার উৎপাদনকারী দেশ চিলিতে প্রস্তাবিত একটি খনন প্রকল্প বাতিল করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। চিলিতে পিনোশে আরোপিত নব্য উদারবাদী মডেলের আওতায় সরকারি খাত এড়িয়ে বেসরকারি খাতে যে অবসর ভাতাব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, তাও বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
বোরিক নির্বাচিত হওয়ার পর সান্তিয়াগোর রাস্তায় তাঁর তরুণ সমর্থকেরা এ নেতার নাম লেখা পতাকা উড়িয়েছেন। তাঁরা আনন্দে লাফাচ্ছিলেন এবং বিজয় উল্লাস করছিলেন। বোরিস সোতো নামের এক শিক্ষক বলেন, ‘এ এক ঐতিহাসিক দিন। আমরা যে শুধু ফ্যাসিবাদী আর উগ্র ডানপন্থীদের পরাজিত করেছি তা নয়, ভয়কেও জয় করেছি।’
প্রথম দফার তুলনায় দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে ১২ লাখ মানুষ বেশি ভোট দিয়েছেন। এদিন মোট ভোট পড়েছে ৫৬ শতাংশ। গত নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক ভোট পড়েছে এবার। নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিয়ে এবং বোরিককে অভিনন্দন জানিয়ে টুইটারে নিজের একটি ছবি পোস্ট করেন প্রতিদ্বন্দ্বী কাস্ত। বোরিকের প্রচার শিবিরে গিয়ে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও দেখা করেন তিনি। চিলির বিদায়ী প্রেসিডেন্ট এবং রক্ষণশীল ধনকুবের সেবাস্তিয়ান পিনেরাও বোরিকের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের অন্তর্বর্তীকালীন তিন মাসে বোরিককে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক উইলসন সেন্টারের লাতিন আমেরিকা কর্মসূচিবিষয়ক প্রধান সিনথিয়া আর্নসন বলেন, ‘যে ঐতিহাসিক সংখ্যায় ভোট পড়েছে, তাতে কাস্তের পক্ষে পরাজয় না মেনে নিয়ে উপায় ছিল না। এমনকি চূড়ান্ত পল ঘোষণার আগেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি। একইভাবে পিনেরাও ভদ্র আচরণ করেছেন।’
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০ বছর আগের মতো বোরিকের এখন আর অত লম্বা চুল নেই। তবে মুখে চিরচেনা সে দাড়ি আছে। ১০ বছর আগের ভূমিকার থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার কাঁধে নিতে যাচ্ছেন বোরিক। ইতিমধ্যে চিলিকে বিকেন্দ্রীকরণ করে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। নারী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, আদিবাসীদের জন্য উন্নয়নমূলক খাতসহ বিভিন্ন খাতে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন এ তরুণ নেতা। তবে তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে জেনারেল পিনোশে প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থার জাল থেকে দেশকে মুক্ত করা। আর আগামী চার বছরে তিনি এ প্রক্রিয়া চালাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।