বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি অর্থ উদ্ধারে কোনো খবর নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:৩২ এএম, ৬ ফেব্রুয়ারী,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৩৪ পিএম, ৩ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই আলোচনার ঝড় তুলেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা। সেই ঘটনার পাঁচ বছর পূর্তি হলো গতকাল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া বাকি ছয় কোটি ৬০ লাখ ডলার (টাকার অঙ্কে ৫৬০ কোটি টাকা) আদৌ পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। যদিও শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল, পুরো অর্থ দুই-তিন বছরের মধ্যে ফেরত আনা সম্ভব হবে। সাইবার হামলার মাধ্যমে বড় অঙ্কের এই টাকা চুরির ঘটনা বাংলাদেশে ছিল প্রথম।
বিশ্বের অন্যতম আলোচিত রিজার্ভ চুরির এই ঘটনার পাঁচ বছর পূর্ণ হলেও সেই অর্থ উদ্ধারে আশাব্যঞ্জক কোনো খবর এখনও মেলেনি। চুরির প্রথম বছর শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের স্বেচ্ছায় দেয়া অর্থের বাইরে আর এক টাকাও উদ্ধার হয়নি। ফিলিপাইন থেকে অর্থ ফেরতে কোনো অগ্রগতি না থাকায় এখন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বাংলাদেশের মামলা চলছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রিজার্ভ থেকে চুরির অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য শুরুর দিকে ফিলিপাইন ব্যাপক সহায়তা করেছিল। দেশটির বিভিন্ন সংস্থা তখন বাংলাদেশের পক্ষে ১২টি মামলা করে। তবে দেশটির সরকার পরিবর্তনের পর সেই তৎপরতায় ভাটা পড়ে। সমঝোতার মাধ্যমে অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেও সফল হয়নি। যে কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে তৃতীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ। প্রথমে ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে বাংলাদেশের পক্ষে একটি মামলা দায়ের করে নিয়োগকৃত ল ফার্ম কোজেন ও’কনর। তবে গত বছরের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের ওই আদালত জানিয়ে দেয়, মামলাটি তাদের কোর্টের এখতিয়ারাধীন নয়। ফলে অর্থ ফেরত ও জড়িতদের শাস্তির জন্য গত বছরের ২৭ মে নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট কোর্টে মামলা করা হয়। এ মামলায় এখনও শুনানি শুরু হয়নি। ফলে ওই আদালতে মামলা চলবে কি না বা কবে নাগাদ মামলা শেষ হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। যদিও ল ফার্মকে মাঝেমধ্যে ফি হিসেবে বিপুল অর্থ দিতে হচ্ছে। আবার বিভিন্ন প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া বাকি অর্থ ফেরত পাওয়া অনেক কঠিন। কেননা শুরুতেই বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের কার্যক্রম যেমন হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরপরই ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া যেত। তা না করে ফিলিপাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনেক দেরি করা হয়েছে। তখন দেখা গেছে, কিছু লোক এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে রিজার্ভ চুরি নিয়ে মন্তব্য করা ও কার্যক্রমও একেক সংস্থা থেকে একেক রকম হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমন্বয় ছিল না। তিনি বলেন, আইনগত পদক্ষেপ নিতেও দেরি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্ট মামলাটি রাখেনি। স্টেট কোর্টে পাঠিয়েছে। অন্যদিকে দেশে যে তদন্ত করা হয়েছে, সেই প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি। ফলে কে কোথায় কীভাবে দোষীÑ দেশেই তা স্পষ্ট নয়। সামগ্রিকভাবে দেশে-বিদেশে বিষয়টি জটিল করে ফেলা হয়েছে। ফলে এই অর্থ উদ্ধার কঠিন বলে মনে করেন তিনি।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর অজ্ঞাতপরিচয় হ্যাকাররা আন্তর্জাতিক বার্তা প্রেরণের নেটওয়ার্ক সুইফটে ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে আট কোটি ১০ লাখ ডলার নেয়া হয় ফিলিপাইনের আরসিবিসির মাকাতি শহরের জুপিটার স্ট্রিট শাখার চারটি ভুয়া অ্যাকাউন্টে। শ্রীলঙ্কার একটি ব্যাংকে নেয়া হয় দুই কোটি ডলার। শ্রীলঙ্কায় যাওয়া অর্থ ওই সময়ই ফেরত এসেছে। আর ফিলিপাইনে নেয়া অর্থের মধ্যে দেশটির আদালতের নির্দেশে ক্যাসিনো মালিক কিম অং ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রায় দেড় কোটি ডলার ফেরত দেয় বাংলাদেশকে। বাকি ছয় কোটি ৬০ লাখ ডলার ফেরত পাওয়ার চেষ্টা চলছে। যদিও আশাপ্রদ তেমন কোনো খবর নেই।
অর্থ ফেরতে অগ্রগতি না হলেও চুরি যাওয়া ডলার বেশিরভাগই কোথায় গেছে, সে বিষয়ে ফিলিপাইন থেকেই তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ। দেশটি থেকে ফেরত আনতে না পারা অর্থের মধ্যে ১৪ মিলিয়ন ডলারের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। বাকি অর্থের মধ্যে ফিলিপাইনের সোলায়ের ক্যাসিনোর অ্যাকাউন্টে ফ্রিজ আছে দুই কোটি ৯০ লাখ ডলার। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ওই সময় নিজ থেকে ২২ লাখ ডলার বাংলাদেশকে দিতে রাজি হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ চেয়েছিল পুরো অর্থ। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরির অর্থ ভাঙিয়ে দেয়ার অপরাধে লাইসেন্স বাতিল হওয়া ফিলিপাইনের মুদ্রা বিনিময়কারী প্রতিষ্ঠান ফিলরেমের অ্যাকাউন্টে ফ্রিজ রয়েছে এক কোটি ৭০ লাখ ডলার। কিম অংয়ের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন এমন দু জনের অ্যাকাউন্টে জব্দ রয়েছে ১২ লাখ ডলার। এসবের বাইরে কিম অংয়ের কাছে আরও দেড় কোটি ডলারের বেশি রয়েছে। যদিও কিম অং দাবি করে আসছেন, জুয়াড়িরা ক্যাসিনোতে চিপস কিনে জুয়া খেলে ওই অর্থ জিতে নিয়ে গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা হয়েছে। ওই মামলার রায় পাওয়ার অপেক্ষায় আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রায় পাওয়ার পর পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
রিজার্ভ থেকে অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ফিলিপাইন শুরুর দিকে অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য বেশ তৎপর ছিল। পরবর্তী সময়ে তাদের সরকার পরিবর্তনের পর তারা আর উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা করছে না। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মামলা করা হয়। এই মামলার ফলাফল পাওয়ার পর কবে অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। আবার যুক্তরাষ্ট্রের আদালত বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিলেও ফিলিপাইন সেটি মানবে কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। সব মিলিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় অর্থ উদ্ধার যে বেশ জটিল, তা পরিস্কার। যে কারণে শুরু থেকেই সমঝোতার মাধ্যমে অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা ছিল বাংলাদেশের। সেটি না হওয়ায় আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক বিষয় হওয়ায় বাংলাদেশ এই অর্থ উদ্ধারের জন্য এই তৎপরতা চালিয়ে যাবে।
রিজার্ভ চুরির ঘটনা ফাঁসের পর তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। আর দুই ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম ও নাজনীন সুলতানাকে অব্যাহতি দেয় সরকার। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটির রিপোর্টে দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি উঠে আসে। যদিও প্রত্যক্ষভাবে কেউ জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি। এ ঘটনায় ওই সময়ই মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংস্থাটি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কয়েক দফা সময় নিয়েছে। অবশ্য রিজার্ভ চুরির ঘটনা জানাজানির পর বাংলাদেশ ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংক খাতের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।