শেয়ার কারসাজিতে এনআরবিসি ব্যাংক ও চেয়ারম্যানের নাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:২২ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:৩৫ এএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও আবুল খায়ের হিরোর পর এবার শেয়ার কারসাজিতে বেসরকারি ব্যাংক এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক লিমিটেড এবং ব্যাংকটির চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমালের নাম সামনে এসেছে। আবুল খায়ের হিরো চক্রের পাশাপাশি এনআরবিসি ব্যাংক এবং ব্যাংকটির চেয়ারম্যানসহ ২০ জন এ কারসাজির সঙ্গে জড়িত বলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কিন্তু এ ঘটনায় পারভেজ তমাল ও এনআরবিসি ব্যাংককে এখন পর্যন্ত কোনো জরিমানা করা হয়নি।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আলোচিত বিনিয়োগকারী আবুল খায়ের হিরো ও তার সহযোগীরা কারসাজি করে যেসব শেয়ারের দাম বাড়িয়েছেন সেগুলো একই সময়ে কেনা-বেচা করেছেন এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমালও। তিনি নিজের নামে থাকা দুটি ব্রোকার হাউজের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ওই সময় সংশ্লিষ্ট শেয়ারগুলোতে বিনিয়োগ করেন। সেখান থেকে রিয়েলাইজড গেইনের পাশাপাশি আন রিয়েলাইজড গেইন করেন তিনি। ওই কারসাজির তালিকায় আবুল খায়ের হিরো, হিরোর বাবা আবুল কালাম মাতবর, হিরোর কোম্পানি ডিআইটি কো-অপারেটিভ, তার বোন কনিকা আফরোজ, এনআরবিসি ব্যাংক এবং এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পারভেজ তমালসহ মোট ২০ জনের নাম এসেছে। এনআরবিসি ব্যাংকও নিজ নামে বিনিয়োগ করে রিয়েলাইজড ও আন রিয়েলাইজড গেইন করে।
ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিরিজ লেনদেনের মাধ্যমে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ অক্টোবর সময়ে আবুল খায়ের হিরো চক্রটি ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্সের শেয়ার ৮৯ টাকা বাড়ায়। ৯ সেপ্টেম্বর বিমা কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ১৩৭ টাকা ৫০ পয়সা। সেখান থেকে ২৬ অক্টোবর লেনদেন হয় ২২৬ টাকা ৫০ পয়সায়। ওই কারসাজির তালিকায় আবুল খায়ের হিরো, হিরোর বাবা আবুল কালাম মাতবর, হিরোর কোম্পানি ডিআইটি কো-অপারেটিভ, তার বোন কনিকা আফরোজ, এনআরবিসি ব্যাংক এবং এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পারভেজ তমালসহ মোট ২০ জনের নাম এসেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পুরো কেনা-বেচাটি হয় হিরো ও তার সহযোগীদের মধ্যে। লেনদেনগুলো ছিল প্রকৃতপক্ষে সাজানো ও মিথ্যা। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত ও প্রলুব্ধ করার লক্ষ্যে এসব লেনদেন করা হয়। এ ঘটনায় হিরোর পরিবারের সদস্যদের জরিমানা করা হয়েছে।
ডিএসইর প্রতিবেদন মতে, উল্লেখিত সময়ে এনআরবিসির চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমাল অগ্রণী ইক্যুইটি অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টের (১৬০৫১১০০৬৪৮১৫০৮৮) মাধ্যমে ১৬ লাখ ৭০ হাজার শেয়ার কেনা-বেচা করেন। অর্থাৎ তিনি সাত লাখ ৯০ হাজার শেয়ার কিনে দাম বাড়িয়ে আট লাখ ৮০ হাজার শেয়ার বিক্রি করেন। শেয়ার কেনা-বেচা বাবদ মোট লেনদেন হয় ১০ কোটি ৭১ লাখ ৩২ হাজার ৫৪৭ টাকা। একই সময়ে তার কোম্পানি এনআরবিসি ব্যাংক ডেল্টা লাইফের ছয় লাখ ৬৩ হাজার ২৮৪টি শেয়ার কিনে ১৬ লাখ ৯১ হাজার ৩৩৩টি শেয়ার বিক্রি করেন। অর্থাৎ তিনি মোট ২৩ লাখ ৫৪ হাজার ৬১৭টি শেয়ার কেনা-বেচা করেন। যা টাকার অঙ্কে ১০ কোটি ৭১ লাখ ৩২ হাজার ৫৪৭ টাকা। একইভাবে সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে ফরচুন সুজ লিমিটেডের শেয়ারের দাম গত বছর ২০ মে ২১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ২২ টাকা বেড়ে ১৭ জুন লেনদেন হয় ৪৩ টাকা ৮০ পয়সায়। অর্থাৎ শেয়ার প্রতি দাম বাড়ে ৯৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আবুল খায়ের হিরো ও তার সহযোগীরা শেয়ার কিনে দাম বাড়ানো শুরু করেন, যা অব্যাহত থাকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত। ২০২২ সালের ৩১ মার্চ শেয়ারটির সর্বোচ্চ ১৪০ টাকা ৭০ পয়সায় লেনদেন হয়। অর্থাৎ শেয়ারটি দাম বাড়ে ১১৯ টাকা।
ডিএসইর আরেক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এক মাসের মধ্যে শেয়ারের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি তদন্ত করা হয়েছে। এ সময়ে আবুল খায়ের হিরো, তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, তার বাবা আবুল কালাম মাতবর, বোন কনিকা আফরোজ, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, এনআরবিসি ব্যাংক এবং এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমালসহ ২০ জনের নাম এসেছে। এনআরবিসি ব্যাংক সিকিউরিটিজের মাধ্যমে ১৬ কোটি ৬০ লাখ ৬৭ হাজার ৩৯১ টাকার এক কোটি ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৭৯২টি শেয়ার কিনে দাম বাড়ায়। যা মোট শেয়ার লেনদেনের ৬ দশমিক ৭২ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান তার নামের দুটি বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৩৩ কোটি ২১ লাখ ৩৪ হাজার ৭৮২ টাকার শেয়ার কিনে দাম বাড়ান। এর মধ্যে এনআরবিসি ব্যাংক সিকিউরিটিজের মাধ্যমে বিও অ্যাকাউন্টের (১২০৫৯৫০০৭৩৬০১৫৩৯) ২০ লাখ ৪০ হাজার ৮৬১টি শেয়ার ১৬ কোটি ৬০ লাখ ৬৭ হাজার ৩৯১ টাকায় কেনেন। যা মোট লেনদেনের ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। তার অপর বিও অ্যাকাউন্ট রয়েছে অগ্রণী ইকুইটি অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের (১৬০৫১১০০৬৪৮১৫০৮৮) মধ্যে। এটির মাধ্যমে তিনি মোট ১৯ লাখ ৬৮ হাজার ৯৩৬টি শেয়ার ১৬ কোটি ৬০ লাখ ৬৭ হাজার ৩৯১ টাকায় কেনেন। কারসাজি চক্রের মূল হোতা আবুল খায়ের হিরোও এ সময়ে ২০ লাখ ২৫ হাজার শেয়ার কেনেন ১৬ কোটি ৬০ লাখ ৬৭ হাজার ৩৯১ টাকায়।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, সিরিয়াল ট্রেডিং পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বড় ক্রাইম। এই ক্রাইমের কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। আমাদের দেশেও সেই আইন আছে। কিন্তু আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত যারা কারসাজির সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। শেয়ার কারসাজির পরও কেন শাস্তি দেওয়া হয়নি— জানতে চাইলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।তবে বিএসইসির কমিশনার আব্দুল হালিম বলেন, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত মূলহোতাদের জরিমানা করা হয়েছে। ‘রিয়েলাইজড গেইন যারা করেছেন তাদের জরিমানা করা হয়েছে। অর্থাৎ, দাম বাড়ার পর শেয়ার বিক্রি করে যারা মুনাফা তুলে নিয়েছেন তাদের জরিমানা করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত ফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি।