গার্মেন্ট শিল্পে অর্ডার কমছে, লক্ষ্য পূরণে শঙ্কা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:১৪ পিএম, ২০ জুলাই,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ১২:৫৯ এএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বাংলাদেশের প্রধান রফতানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই উত্তাপ এসে লেগেছে দেশের পোশাক খাতে। কারণ বাংলাদেশের বৃহত্তম এই দুই বাজারের ক্রেতারা নতুন পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে বাংলাদেশের বেশির ভাগ তৈরি পোশাক কারখানার ক্রেতারাও প্রায় ৩০ ভাগ অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন বলে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সূত্রে জানা গেছে। অথচ কয়েক মাস আগেও বিপুল কার্যাদেশ পাচ্ছিল দেশের পোশাক কারখানাগুলো। এখন একেবারে উল্টো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে রফতানি আয় গত মাসের তুলনায় কমে গেছে। আর ডলারের বাজারে অস্থিরতায় রেমিট্যান্স কমার পাশাপাশি দেশের রিজার্ভও কমেছে। এতে পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খুলতেও হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
সূত্র মতে, ইতিমধ্যে ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দার আঁচ পড়তে শুরু করেছে। দেশের তৈরি পোশাকের আরেক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা না হলেও মূল্যস্ফীতির কারণে তৈরি পোশাকের চাহিদা অনেকাংশে কমে আসবে। ইতিমধ্যে এসব দেশের মানুষ ব্যয়ের তালিকা কাটছাঁটও করছে। বিশ্বের এই বড় দুই বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে দেশের তৈরি পোশাক খাত। কমতে পারে রফতানি অর্ডার। কারণ তৈরি পোশাক রফতানির বেশির ভাগ আয় আসে ইউরোপের বাজার থেকে। শুধু তৈরি পোশাক নয়, অন্য পণ্যের ক্ষেত্রেও একই প্রভাব পড়বে। তাই ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা যত গভীর হবে, দেশের রফতানি আয়ে তত নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সূত্র জানায়, মহামারিকালে এইচঅ্যান্ডএম ছাড়া বাকি প্রায় সব ব্র্যান্ডই ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের কার্যাদেশ বাতিল করে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তৈরি পোশাক খাত। প্রতিটি পোশাক কারখানা মন্দার মুখে পড়ে। এ সময় পোশাক রফতানি কমে আসে। এ ছাড়া পরিবহন খরচ প্রায় চার গুণ বেড়ে যায়। কাঁচামালের দামও বেড়ে যায় ১৫-২০ শতাংশ। এর মধ্যেও গত অর্থবছর তৈরি পোশাক শিল্প শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে সংকট শুরু হওয়ায় পোশাক রফতানির এই উত্থান ধারায় ছেদ পড়েছে। জুলাই থেকে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পোশাক কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন সক্ষমতার ৭০ শতাংশ বুকিং অর্ডার পাচ্ছে বলে জানা গেছে। ইউরোপের দেশগুলো সারা বছর যে সংখ্যক টি-শার্ট বা গেঞ্জি কেনে, তার প্রায় ৪১ শতাংশই বাংলাদেশি পোশাক কারখানা সরবরাহ করে।
ইপিবির সর্বশেষ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে মোট রফতানি আয়ের ৮১.৬৫ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। যার মধ্যে নিট পোশাক থেকে এসেছে ২ হাজার ৯৮ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সম্প্রতি কার্যাদেশ কমে গেছে। আসন্ন বসন্ত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) ৩০ শতাংশ হয়েছে। চার মাস আগের তুলনায় এটা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি এমন যে, বেঁচে থাকাই এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক ছোট কারখানার মালিক প্রতিদিন আমাকে কিছু অর্ডার দেয়ার জন্য ফোন করেন। কিন্তু তাদের সাহায্য করতে পারি না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে পরবর্তীতে কী ঘটবে তা আমি জানি না। বিকেএমইএ’র আরেক নেতা এ এইচ এম আসলাম সানী ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতিতে পোশাকের অর্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মন্দার আশঙ্কায় বিশ্বব্যাপী পোশাকের চাহিদার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তিনি বলেন, আমার কারখানায় সামনের মাসগুলোতে ১৬ শতাংশ কম অর্ডার পাচ্ছে। একদিকে ডলারের দাম বৃদ্ধি অন্যদিকে কাঁচামালের দামও বেড়েছে। ফলে পোশাক খাত উভয়মুখী সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালক এবং নিপা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. খসরু চৌধুরী বলেন, তার কোম্পানি প্রতি মাসে ৩০ লাখ পিস পোশাক তৈরি করে। কিন্তু আগামী নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তার কোম্পানির সক্ষমতার মাত্র ৫০ শতাংশ বুক করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ছয় মাস আগে যে পরিমাণ অর্ডার পাচ্ছিলাম, তার থেকে ১০-১২ শতাংশ কম পাচ্ছি এখন। তাই লোকসান যাতে ভাগাভাগি করে নেয়া যায়, সেজন্য ক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনা করছি। খরচ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে মো. খসরু চৌধুরী বলেন, যুদ্ধের কারণে পেট্রো কেমিক্যালের দাম বেড়েছে। এ জন্য কাঁচামালের মোট দাম ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অন্যদিকে ব্র্যান্ডগুলো দাম কমানোর জন্য দরকষাকষি করছে। স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি শোভন ইসলাম বলেন, হাই-ভ্যালু ব্র্যান্ডগুলোর অর্ডার ১০ শতাংশ কমেছে, আর যারা মৌলিক পণ্যের ওপর জোর দেয় তাদের অর্ডার কমেছে ৩০ শতাংশ। আগস্ট-ফেব্রুয়ারিতে অর্ডারের ঘাটতি থাকবে। মন্দার কারণে ইউরো আর ডলারের মান এখন প্রায় একই। এর অর্থ, ইউরোপের প্রধান বাজারগুলোতে আমাদের পণ্যের চাহিদা হ্রাস পাবে, কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে।
বিজিএমইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, মন্দার কারণে গ্রাহকরা তাদের অগ্রাধিকার বদলে ফেলেছে। তারা পোশাকের বদলে খাদ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পেছনে খরচ করছে। আর তারই প্রতিফলন দেখছি অর্ডারের সংখ্যায়। ইতিমধ্যেই কার্যাদেশের স্বল্পতার কারণে শতাধিক সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেছে। বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, সদস্যরা জানিয়েছেন, টার্গেট ও ওয়ালমার্ট কনফার্ম করা অর্ডার বাতিল করেছে। এ দুই খুচরা বিক্রেতার কাছেই প্রচুর অবিক্রীত পণ্য রয়ে গেছে বলে জানানো হয়েছে ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে। তারা এখন পণ্য বুঝে নেয়ার জাস্ট-ইন-টাইম পদ্ধতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, তাদের ২০ শতাংশ ইউডি কমেছে। রফতানিকারকরা শিপমেন্ট স্থগিত হয়ে যাওয়ার কথাও জানাচ্ছেন। তবে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কোনো কার্যাদেশ বাতিলের খবর জানায়নি। গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানার মালিক আতিকুর রহমান বলেন, সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে ক্রেতারা ধীরে ধীরে কাজের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন। গত জুনের শেষ ২০ দিনে, তিনি একটি পোশাকও তৈরি করতে পারেননি। কিন্তু শ্রমিকদের ২০ লাখ টাকা মজুরি ঠিকই তাকে পরিশোধ করতে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি কারখানা বিক্রির পরিকল্পনা করেছেন। শিল্প সংশ্লিষ্ট ও শিল্প পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, গত ২৯শে জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি সভা করেছে। বৈঠকে জানানো হয়, প্রায় ৮৮টি কারখানার মালিক কার্যাদেশের অভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেননি। ১০০টিরও বেশি কারখানা শুধুমাত্র ন্যূনতম কার্যাদেশ নিয়ে কোনোমতে চালু হয়েছে, যার ফলে প্রচুর লোকসান হয়েছে, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে, পোশাক রপ্তানি আয় এপ্রিলে ৩.৯৩ বিলিয়ন ডলার থেকে মে মাসে ৩.১৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি যুদ্ধের কারণে ঘটেছে এবং ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে।