সুপেয় পানির প্রকল্পে কাজ না করেই সাড়ে ৬ কোটি টাকা লোপাট!
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৪৬ এএম, ৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:২১ পিএম, ১৮ নভেম্বর,সোমবার,২০২৪
টাঙ্গাইলের কয়েকটি উপজেলায় সুপেয় পানির প্রকল্পে কাজ শেষ না করেই সাড়ে ৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ‘অনিয়মে’ সহযোগিতা করায় জেলা নির্বাহী প্রকৌশলীকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অন্য অভিযুক্তরা। ঘটনার সাত বছর পেরিয়ে গেলেও লোপাটের অর্থ ফেরত পায়নি সরকার। অর্থ ফেরত চেয়ে গত নভেম্বরের শুরুতে ওই তিন প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের পাওনা বিল স্থগিত করতে সারাদেশের নির্বাহী প্রকৌশলীদের নির্দেশ দিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর (ডিপিএইচই)। জানা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ি, মধুপুর, বাসাইল, সখিপুর, ভুয়াপুর পৌরসভা ও নাগরপুর উপজেলার তেবাড়িয়া গ্রামে নিজস্ব অর্থায়নে সুপেয় পানি সরবরাহে কর্মসূচি শুরু করে ডিপিএইচই। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ কোটি টাকা। কিন্তু কাজের উল্লেখযোগ্য কোনও অগ্রগতি ছাড়াই ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকার বিল তুলে নেয় তিন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
অভিযোগ রয়েছে, এতে সহযোগিতা করেছেন তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান ও টাঙ্গাইল জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনির হোসেন মোল্লা। কাগজপত্রে তিন প্রতিষ্ঠানের নাম থাকলেও পেছন থেকে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজটি করেছেন টাঙ্গাইল জেলার টিউবওয়েল মেকানিক মো. মাহফুজুর রহমান। তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রোকেয়া এন্টারপ্রাইজের নামে বিল তোলা হয়েছে ৩ কোটি ১৩ লাখ ২৪ হাজার ৯০০ টাকা। এছাড়া মুক্তি এন্টারপ্রাইজ ১ কোটি ৮৫ লাখ ও সাবা এন্টারপ্রাইজ ৪২ লাখ টাকা। এর বাইরেও ১ কোটি টাকার হিসাবে গরমিল রয়েছে। ঘটনা জানাজানি হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে নির্বাহী প্রকৌশলী মনির হোসেন মোল্লার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে অপসারণ করা হয়। সম্প্রতি টাকা ফেরৎ পেতে উদ্যোগ নিয়েছে ডিপিএইচই। কর্মসূচিতে সংঘঠিত অনিয়মের বিষয়ে দায়-দায়িত্ব নির্ধারণপূর্বক মতামতসহ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ঢাকা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু গত এক বছর চার মাসেও এ কমিটি কোনও প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। ফলে গত ৪ আগস্ট আবারও কমিটিকে চিঠি দেয় সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী। কমিটিকে দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়।
যা বলছে তদন্ত কমিটি : তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া বলেন, তদন্তে আমরা ব্যাপক অনিয়ম পেয়েছি। যে টাকার বিল দেওয়া হয়েছে মাঠে সেরকম কাজ পাইনি। কিসের ভিত্তিতে এত বিল দিলো বুঝে আসে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তিনি বলেন, সাবা ও রোকেয়া এন্টারপ্রাইজের কোনও সন্ধান আমরা পাইনি। আর মুক্তি এন্টারপ্রাইজ ডিপিএইচইতে এখন কাজ করছে। এখানে মজার বিষয় হলো— এই লাইসেন্স দিয়ে অন্য একজন সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করেছে। অনেকেই আমাদের কাছে অভিযোগ করেছে টিউবওয়েল মেকানিক মো. মাহফুজ এই কাজটি করেছে। সে কিন্তু ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আমরা চিনি যে প্রতিষ্ঠানের নামে বিল হয়েছে সেটিকে। আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরত চেয়ে প্রধান প্রকৌশলী মুক্তি এন্টারপ্রাইজকে চিঠি দিয়েছিলো— প্রথমে রিসিভ করেনি, পরে বিল আটকে দেওয়া হলে মুক্তি এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হামিদ গত সপ্তাহে প্রধান প্রকৌশলী বরাবর আবেদন করে। এখন তিনি বলছেন, এ কাজের সঙ্গে তার নাকি কোনও সম্পর্ক নেই। তদন্ত করে প্রতিবেদন আমরা প্রধান প্রকৌশলী বরাবর জমা দিয়ে দিয়েছি।
যা বললেন মনির : অনিয়মে অভিযুক্ত টাঙ্গাইল জেলার সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনির হোসেন বলেন, অভিযোগ সত্য নয়, মূলত আমাদের ডিপার্টমেন্টের মাহফুজ নামের একজন টিউবওয়েল মেকানিক তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী নুরুজ্জামান ও স্থানীয় মেয়রের সঙ্গে সমঝোতা করে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজগুলো করেছিল। মাহফুজ মেকানিক হলেও প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে তার বিশেষ সখ্য ছিল। চাকরির পাশাপাশি সে নিয়মিত দেশব্যাপী ঠিকাদারি করতো। যে তিনটি লাইসেন্সে কাজ হয়েছে, মাহফুজই ছিল এর লাইমলাইটে। এই লাইসেন্সের মালিকদেরকেও আমি কখনও দেখিনি। কাজের নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) এবং ওয়ার্ক অর্ডারসহ সবকিছু করেছে এই মাহফুজ। ঘটনার পর কাজ তোলার জন্য মাহফুজের সঙ্গে আমি অনেকবার যোগাযোগ করেছি, সে ধরা দেয়নি। পরে তার এলাকায় লোক পাঠিয়েছিলাম তাদেরও সে মারধর করেছে, প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে তাদের পাঠিয়ে দিয়েছে। মনির হোসেন বলেন, ওই সময়ে মুক্তি, রোকেয়া ও সাবা এন্টারপ্রাইজের দুর্দ- প্রতাপ ছিল। এদের সঙ্গে কাজ করা খুব মুশকিল ছিল। একটা পৌরসভায় কাজ করতে গেলে আগে মেয়রকে সালামি দিয়ে কাজ করতে হতো। আমাকে যখন ২০১৬ সালের মার্চ মাসে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয় তখনও কাজটা পুরোদমে চলছিল। ধনবাড়িতে পানি সরবরাহের কাজের উদ্বোধন করা হয়েছিল। ১০টি পাম্প হাউজ ও ৩৮ কিলোমিটারে পাইপ লাইন বসানো হয়েছিল। কাজ এখন পর্যন্ত সাইটে আছে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকাতে হয়তো কিছু পাইপলাইন চুরি হতে পারে। মির্জাপুর উপজেলায় গোডাউনে ঠিকাদারের মালামালও রয়েছে। বিভিন্ন কায়দা-কানুন করে এদের গুছিয়েও নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু আমাকে সরিয়ে দেয়ার খবর পেয়ে সুযোগ বুঝে ঠিকাদাররা কাজ ফেলে পালিয়ে যায়। ‘কাজ শেষ হওয়ার আগেই কেন এত বিল দিলেন’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই কাজ সরাসরি তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধায়নে হয়েছে। উনি নিজে গিয়ে কাজের অগ্রগতি দেখেছেন। তার নির্দেশ অনুযায়ী সব পেমেন্ট করা হয়েছে। চিঠিতে ওনার লিখিত নির্দেশ আছে। এখানে আমার তেমন কিছু করারও ছিল না। ওই সময় যখন মালামালগুলো আমাদের স্টোরে জমা হয়, তখন মালামালের মূল্য ও যতটুকু কাজ হয়েছে তার মূল্য হিসাব করেই ওই বিলটা দেওয়া হয়েছিল। দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন (সিএস) অনুসারে সাড়ে ৭ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। সেখানে ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা পেমেন্ট করা হয়েছে।
সেই মাহফুজ এখন কোথায় : খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মনির হোসেন মোল্লা চাকরি থেকে অপসারণ হওয়ার পর নিজেও চাকরি ছেড়ে এলাকায় গা ঢাকা দিয়েছেন মো. মাহফুজ রহমান। পেশা পাল্টে টিউবওয়েল মেকানিক থেকে হয়েছেন জনপ্রতিনিধি। বর্তমানে তিনি পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। আসন্ন নির্বাচনেও তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকায় চাকরি থাকা অবস্থায় এলাকায় সব সময় দামী গাড়ি নিয়ে যেতেন মাহফুজ। নিজেকে পরিচয় দিতেন ডিপিএইচই’র বড় কর্মকর্তা বলে। হঠাৎ চাকরি ছেড়ে ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। সেই সঙ্গে বাগিয়ে নিয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক ইউপি সদস্য জানান, বছরখানেক আগে ঢাকা থেকে দুজন লোক এসেছিল চেয়ারম্যানের কাছে, তাদের সঙ্গে তার অনেক বাগবিত-া হয়েছিল। পড়ে শুনলাম তারা ডিপিএইচই’র লোক। তাদের সঙ্গে নাকি টাকা-পয়সার লেনদেন ছিল। তাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমে নিজেকে অভিযুক্ত মাহফুজ হিসেবে অস্বীকার করেন।
তিনি বলেন, ডিপিএইচইতে মাহফুজ নামে আরও একজন আছে, সে তাদের সঙ্গে ঠিকাদারি করে কিন্তু আমি ওই মাহফুজ না। পরে প্রমাণ দিলে তিনি বলেন, আমিই সেই মাহফুজ। তবে আমি কোনও ঠিকাদারি করি নাই, বিল হয়েছে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে। বরং রোকেয়া এন্টারপ্রাইজ সাড়ে ৩ কোটি টাকার কাজ করেও বিল পায়নি। ওই কাজে আমি লেবার দিয়ে সহযোগিতা করেছিলাম। পাবনায় অনেক কম খরচে লেবার পাওয়া যেত। সেখান থেকে আমি একটা কমিশন পেতাম। এর বাইরে এই কাজের সঙ্গে আমার কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই। তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী নুরুজ্জামান স্যার খুব ভালো মানুষ ছিলেন, আমাকে স্নেহ করতেন। একই সময় চাকরি ছাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে মেকানিক পোস্টটা বেমানান ছিল একারণেই ছেড়ে দিয়েছি।
কাজের বর্তমান অবস্থা : এ ঘটনার পর থেমে আছে সুপেয় পানি সরবরাহের কাজ। ভোগান্তিতে পড়েছে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা। সম্প্রতি চার পৌরসভায় নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে টাঙ্গাইল জেলার বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী মায়াজ প্রামাণিক বলেন, ওই সময়ে আমার নতুন চাকরি হয়েছে। আমার আগেও এখানে একজন দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে ওই চার পৌরসভায় নতুন প্রকল্পের কাজ চলছে। কিন্তু ওইসব কর্মসূচির কাজ আর এগোয়নি। বেশির ভাগ কাজই বাকি আছে। অনেক বার তদন্ত কমিটি হয়েছে, তারা এসে সরেজমিন ঘুরে দেখে গেছেন। মনির স্যার যে মালামালের কথা বলছেন— তা আমি দেখিনি। ঠিকাদারদের মালামাল থাকলে তিনি তদন্ত কমিটিকে জানাননি কেন?
যা বলছেন তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী নুরুজ্জামান : তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান বর্তমানে আইইবির (ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিইউট, বাংলাদেশ) সহ-সভাপতি ও খুলনা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সাত বছর আগের ইতিহাস আমার মনে নেই। তারা কী করেছেন না করেছেন আমি কিছুই জানি না। আমি তো ওখান থেকে চলে আসছি। পরবর্তী সময়ে যারা আসছেন এ বিষয়ে তারা জানেন। আমার সঙ্গে তার (মাহফুজ) সম্পর্ক থাকার প্রশ্নই আসে না। জনস্বাস্থ্যের প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান বলেন, অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরত চেয়ে ইতোমধ্যে তিন প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এই তিন প্রতিষ্ঠান কোথাও কোনও কাজ করলে তাদের বিল আটকে দেওয়ার জন্য গত নভেম্বরের শুরুতে সারাদেশের নির্বাহী প্রকৌশলীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।