কাজ না করেও ৪০৬ কোটি টাকা খরচ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:১৫ এএম, ৮ অক্টোবর,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৪৬ এএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
জলাবদ্ধতা নিরসনে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল খালের ময়লা-আবর্জনা অপসারণের মধ্য দিয়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়। এ সুযোগে গত তিন বছর খাল-নালা পরিষ্কার ও উন্নয়নকাজ বন্ধ রাখে সিটি করপোরেশন। জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও এই খাতে খরচ বন্ধ ছিল না। তিন বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪০৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ দেখিয়েছে তারা। তবে কোথায়, কীভাবে কাজ করে এত টাকা খরচ হয়েছে সে তথ্য দিচ্ছেন না সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। সিটি করপোরেশনের গত তিন অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাজেটে দেখা যায়, তিন অর্থবছরে ‘জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাগুলো সংস্কার এবং নালা প্রতিরোধ দেয়াল, সেতু-কালভার্ট নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ’ শিরোনামে ৭১৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অধীনে ৩৯২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বাকি ১৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে খাল-নালা জলাবদ্ধতা দূরীকরণে। হিসাবে কাজ না করেও বছরে গড়ে ১৩৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা জলাবদ্ধতা খাতে খরচ দেখিয়েছে সিটি করপোরেশন।
এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, এত টাকা নয়-ছয় করেছে তারা। না হয় অন্য খাতে খরচ করা টাকার হিসাব মেলাতে জলাবদ্ধতা খাত বেছে নেয়া হয়েছে। জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বলেন, আমি ছুটিতে আছি। এ বিষয়ে অতিরিক্ত প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন।
হুমায়ুন কবির চৌধুরী বলেন, প্রকৌশল বিভাগ থেকে জলাবদ্ধতা খাতে খরচের যে হিসাব আমাদের কাছে উপস্থাপন করা হয়, আমরা তা বাজেটে উপস্থাপন করি। প্রকৃতপক্ষে টাকাগুলো কোন কোন খাতে খরচ হয়েছে, সেটি প্রধান প্রকৌশলী ভালো বলতে পারবেন। আপনি তার সঙ্গে কথা বলুন। ২০১৬ সালে ‘সিটি করপোরেশন এলাকায় কালভার্ট, ড্রেন ও প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ’ এবং ‘মহানগর এলাকায় বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাগুলোর উন্নয়ন’ শীর্ষক দুটি প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায় সিটি করপোরেশন। একই বছরের ২৩ অক্টোবর প্রি-একনেক সভায় প্রকল্প দুটি একীভূত হয়। একই বছরের ৬ ডিসেম্বর ‘সিটি করপোরেশনের আওতায় বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা এবং নালা প্রতিরোধ দেয়াল, সেতু-কালভার্ট নির্মাণ, পুনরায় নির্মাণ’ শিরোনামে ৭১৬ কোটি ২৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার প্রি-একনেক সভায় একীভূত করা ওই প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটি গত অর্থবছরে (২০২০-২০২১) শেষ হয়। প্রকল্পের অধীনে জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত, ২৩৪টি সড়ক সংলগ্ন ড্রেন, ৬৯টি ড্রেন, ২২টি সেতু, চারটি কালভার্ট নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ে নালার প্রতিরোধ দেয়াল, সেতু-কালভার্টকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সড়ক মেরামতে প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থ সড়ক মেরামতে ব্যয় করেছে সিটি করপোরেশন। তবে গত তিন বছরে সিটি করপোরেশন খাল-নালার প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ করেনি বলে জানিয়েছেন সিডিএর এক নির্বাহী প্রকৌশলী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই প্রকৌশলী বলেন, চসিকের ৭১৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের এক বছর আগে নেয়া হয়েছিল। ওই প্রকল্পের অধীনে খাল-নালার প্রতিরোধ দেয়াল, নালা সংস্কার, সেতু-কালভার্ট নির্মাণের কথা থাকলেও তিন বছরে কোনও কাজ করেনি সিটি করপোরেশন। প্রকল্পের টাকাগুলো তারা কোথায় খরচ করেছে তারাই ভালো জানেন।
তিনি আরও বলেন, ওই প্রকল্পের অধীনে যদি তারা একটি নালা ও খালে প্রতিরোধ দেয়াল তুলতো তাহলে সেটি আমরা আমাদের জলাবদ্ধতা প্রকল্প থেকে বাদ দিতে পারতাম। আমাদের প্রকল্পের কনসালটেন্সি সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) পিজিবিলিটি স্টাডি করার সময় এ ধরনের কোনও তথ্য পায়নি। যে কারণে জলাবদ্ধতা নিরসনের সংশ্লিষ্ট সব নালা-খালের কাজ আমাদের করতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, সিডিএ জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ শুরুর পর আমরা জলাবদ্ধতা সংশ্লিষ্ট কোনও কাজ করছি না। জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমানে আমাদের কোনও প্রকল্পও নেই। শুধু রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে আমরা নগরীর ছোটখাটো নালাগুলোতে জমে থাকা মাটি তুলে পরিষ্কার করছি। গত অর্থবছরে আমরা নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নালা থেকে এক লাখ ১৫ হাজার ঘন ফুট মাটি তুলেছি। জলাবদ্ধতা সংশ্লিষ্ট ৭১৬ কোটি টাকার প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি গত বছর শেষ হয়ে গেছে। সিডিএর জলাবদ্ধতা প্রকল্পে কাজ শুরুর পর গত তিন অর্থবছরে প্রকল্পের কাজ হয়েছে।’
গত তিন বছর প্রকল্পের অধীনে আপনারা কি ধরনের কাজ করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী জসিম উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেন। এ সম্পর্কে জানতে মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে নির্বাহী প্রকৌশলী জসিম উদ্দিনের অফিসে গেলে তিনি তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বিভাগীয় প্রধান ছাড়া কারও গণমাধ্যমে কথা বলার সুযোগ নেই জানিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা হয়েছে বলার পরও এ বিষয়ে তথ্য দিতে রাজি হননি। এত টাকা কোন প্রকল্পে খরচ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৭১৬ কোটি টাকার প্রকল্পের অধীনে সিংহভাগ সড়ক মেরামতে খরচ হয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্পের অধীনে ২০-২৫ কিলোমিটার প্রতিরোধ দেয়ালও তৈরি করা হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে কোন কোন সড়ক মেরামত করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি প্রধান প্রকৌশলী ভালো বলতে পারবেন।