আইসিইউয়ের জন্য হাহাকার : সরকারি হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা মাত্র চারটি
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২:০৬ এএম, ৩১ মার্চ,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ১২:০৭ এএম, ১ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
রাজধানীর জিগাতলার বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা সুফিয়া খাতুন কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন। হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তার ছেলে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডেকে মাকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটেন। চিকিৎসকরা তাকে দেখে সন্দেহভাজন করোনা রোগী হিসেবে শনাক্ত করে অনতিবিলম্বে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ভর্তি করাতে হবে বলে জানান। কিন্তু তাকে যে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে সেখানে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই। তিন তিনটি হাসপাতাল ঘুরে অনেক অনুরোধ-উপরোধ করেও মায়ের জন্য আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করতে পারেননি ছেলে। পরে নিরুপায় হয়ে জিগাতলার একটি বেসরকারি হাসপাতালের কেবিনে ওই বৃদ্ধাকে ভর্তি করা হয়। তিনদিন সেখানে চিকিৎসাধীন থেকে তিনি সোমবার (২৯ মার্চ) মারা যান। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে মৃত বৃদ্ধার ছেলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, অনেক চেষ্টা করেও মাকে আইসিইউতে ভর্তি করাতে পারলাম না। হায়াত ছিল কি-না জানি না, তবে আইসিইউতে ভর্তি করাতে না পারার কষ্ট সারাজীবন রয়ে যাবে। বৃদ্ধা সুফিয়া খাতুনের ছেলের মতো আইসিইউতে রোগী ভর্তি করতে না পারার অভিজ্ঞতা এখন অনেকেরই।
বিশেষ করে সন্দেহভাজন করোনা রোগী কিংবা করোনা আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে আইসিইউ অত্যাবশ্যক হলেও অনেকেই শয্যার অভাবে রোগী ভর্তি করাতে পারছেন না। বিশেষ করে করোনা ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর একটি শয্যার জন্য রীতিমতো হাহাকার চলছে। করোনার সংক্রমণ ও রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আইসিইউর এক একটি শয্যা যেন সোনার হরিণ। সরকারি হাসপাতালে তুলনামূলক খরচ কম হওয়ায় করোনা আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের স্বজনরা রোগী নিয়ে সরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন কিন্তু কোথাও শয্যা খালি না পেয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন। বেসরকারি হাসপাতালেও আগের তুলনায় আইসিইউ ভর্তিচ্ছু রোগীর চাপ অনেক বৃদ্ধির ফলে খালি আইসিইউ শয্যা প্রতিদিনই কমছে। খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যানে আইসিইউ শয্যার অপ্রতুলতার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে।
আজ মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা সম্পর্কিত প্রেস ব্রিফিংয়ের তথ্যে দেখা গেছে, রাজধানীতে করোনা ডেডিকেটেড ঘোষিত হাসপাতালে মোট আইসিইউ শয্যার সংখ্যা ১০৮টি। তার মধ্যে ১০৪টি শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছে। ফলে মাত্র চারটি শয্যা খালি রয়েছে।
বেসরকারিভাবে করোনা ডেডিকেটেড ৯টি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ১৮৮টি। তার মধ্যে রোগী ভর্তি রয়েছে ১৪৪টিতে। ফলে দুই কোটি জনসংখ্যার এই রাজধানীতে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে মাত্র অর্ধশতাধিক আইসিইউ শয্যা ফাঁকা রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে একটি আইসিইউ বেডে প্রতিদিন অর্ধলাখের বেশি টাকা বিল পরিশোধের কথা শুনে অনেকে সেখানে রোগী ভর্তি করাতে সাহস পান না।
রাজধানীর ১০টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের মধ্যে উত্তরার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ১৬টি আইসিইউ শয্যার ১৬টিতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ১৬টি শয্যার ১৬টিতে, ৫০০ শয্যার কুর্মিটোলা হাসপাতালের ১০টি শয্যার ১০টিতে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০টি শয্যার ১০টিতে, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ছয়টির ছয়টি, মুগদা জেনারেল হাসপাতালের ১৯টি শয্যার ১৯টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছেন। ২৫০ শয্যার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টির মধ্যে ১৪টিতে রোগী ভর্তি অর্থাৎ দুটি বেড ফাঁকা রয়েছে। আর রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টির মধ্যে ১৩টিতে রোগী ভর্তি রয়েছেন। অর্থাৎ সেখানে দুটি শয্যা ফাঁকা রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে দুই হাজার ৪৬১টি সাধারণ শয্যায় এ মুহূর্তে রোগী ভর্তি দুই হাজার ১২৭ জন। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ১৮৮টি শয্যায় রোগী ভর্তি ১৪৪টিতে। আইসিইউ শয্যা ফাঁকা মাত্র ৪৪টি। নয়টি হাসপাতালের মধ্যে ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের ৩০টি আইসিইউ বেডের ২২টিতে, আসগর আলী হাসপাতালে ৩২টির ২০টিতে, স্কয়ার হাসপাতালের ১৯টির ১৩টিতে, ইবনে সিনা হাসপাতালের পাঁচটির চারটিতে, ইউনাইটেড হাসপাতালের ২২টির ১৪টিতে, এভার কেয়ার হাসপাতালের ৪০টির ৩৪টিতে, ইমপালস হাসপাতালের ৩৫টির ৩২টিতে, এ এম জেড হাসপাতালের ১০টির আটটিতে এবং বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের নয়টির নয়টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছেন। রাজধানীর বেসরকারি নয়টি হাসপাতালে ৯২৮টি সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছে ৫২৮টিতে। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
রোগতত্ত্ব ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের শতভাগ মানুষ মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধিসমূহ মেনে না চললে করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ করা দুরূহ হয়ে পড়বে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান সপ্তাহখানেক আগে করোনার সংক্রমণ আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছিলেন, করোনার সংক্রমণ এখনো প্রতিরোধ করা না গেলে হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ সামাল দেয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। এদিকে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪৫ জনসহ মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৯৯৪ জন। একই সময়ে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৪২ জন। এ নিয়ে শনাক্ত হওয়া মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ছয় লাখ পাঁচ হাজার ৯৩৭ জন। ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশের ২২৪টি সরকারি ও বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে ২৭ হাজার ৩৫০টি নমুনা সংগ্রহ ও ২৬ হাজার ৬২০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ নিয়ে মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়াল ৪৬ লাখ ৪৩ হাজার ৬৪৫টি। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত শনাক্তের মোট হার ১৩ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। নতুন করে করোনা থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন দুই হাজার ১৬২ জন। এ নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ১৮০ জন।