৭৭ ধরনের রাসায়নিকের সন্ধান চমেকের সেই গোডাউনে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:১৬ এএম, ১৭ জানুয়ারী,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:০৫ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
এসিড-অ্যালকালিসহ মোট ৭৭ ধরনের রাসায়নিক পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) পুরনো ফার্মাকোলজি ভবনে দীর্ঘ সময় ধরে তালাবদ্ধ গোডাউনটিতে (স্টোর রুম)। রাসায়নিক গোডাউনটি অপসারণে ৫ দপ্তরের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কমিটি এসব রাসায়নিক চিহ্নিত করেছে। চিহ্নিতপূর্বক তালিকা প্রণয়ন করে এসব রাসায়নিক পরিবেশ অধিদফতরের নীতিমালা মেনে অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি। কমিটির এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে গত ১৩ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদফতরে চিঠি দিয়েছে চমেক প্রশাসন। চমেকের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ সংক্রান্ত কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে পরিবেশ অধিদফতরে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানান ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ।
যা পাওয়া গেছে সে-ই গোডাউনে : চমেক প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ফার্মাকোলজি ভবনের পুরনো সেই গোডাউনে (স্টোর রুম) এসিড-অ্যালকালিসহ বিভিন্ন রাসায়নিকের ১ হাজার ১৮৬টি বোতল, ৩৯টি ইনজেকশন এবং ৩ হাজার ৩০টি ইনজেকশনের এমফল পাওয়া গেছে। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এসব রাসায়নিক স্টোরটিতে তালাবদ্ধ রয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব রাসায়নিক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে স্টোরটির তালা খোলা হয়নি। পরে গোডাউনটি অপসারণে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে চমেক প্রশাসন। সর্বশেষ এ সংক্রান্ত কমিটি গোডাউনে থাকা রাসায়নিক চিহ্নিতপূর্বক তালিকা প্রণয়ন করে এবং পরিবেশ অধিদফতরের নীতিমালা মেনে এসব রাসায়নিক অপসারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
উল্লেখ্য, কলেজের নতুন দশতলা একাডেমিক ভবনটির সাথে লাগোয়া পুরনো দোতলা একটি ভবন রয়েছে। চমেক হাসপাতালের সম্মুখ অংশে এ ভবনটি ফার্মাকোলজি ভবন নামেই পরিচিত, যা এখন জরাজীর্ণ ও অকেজো প্রায়। ভবনটির দোতলায় ফার্মাকোলজি বিভাগের স্টোর রুমে এসব দাহ্য পদার্থ তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। অবশ্য ফার্মাকোলজি বিভাগটি বেশ ক’বছর আগে সেখান থেকে নতুন একাডেমিক ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছে। তবে স্টোর রুমটি আগের মতোই তালাবদ্ধ রয়েছে। এই স্টোর রুমেই বছরের পর বছর ধরে এসব দাহ্য পদার্থ মজুদ আছে। যার কারণে স্টোর রুমটিকে রাসায়নিকের ‘বিপজ্জনক’ গোডাউন হিসেবে অভিহিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সেখানে কি কি রাসায়নিক আছে এবং কি পরিমাণে আছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে ছিল না।
এ নিয়ে গত ২ নভেম্বর একটি পত্রিকার প্রথম পাতায় ‘হাসপাতালের সামনেই রাসায়নিকের গুদাম-চমেকের একটি ভবনে বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে না পারলেও স্টোর রুমটিতে এসিড, অ্যালক্যালি ও রি-এজেন্ট সহ বিভিন্ন রাসায়নিক (দাহ্য পদার্থ) থাকতে পারে বলে জানান চমেকের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
ডা. সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, মেডিকেল কলেজের জন্মলগ্নে ফার্মাকোলজি বিভাগের ব্যবহারিক ও ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারের জন্য এসব দাহ্য পদার্থ কেনা হয়ে থাকতে পারে। তখন কেনা হলেও এসব দাহ্য পদার্থ হয়তো ব্যবহার হয়নি। যার কারণে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। এসব অব্যবহৃত রাসায়নিক বিপজ্জনক অবস্থায় থাকতে পারে শঙ্কা প্রকাশ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে রাসায়নিক গোডাউনটি অপসারণের দাবি জানান শিক্ষক-চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা।
পরবর্তীতে এসব রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থ অপসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করে চমেক প্রশাসন। স্টোর রুমটিতে কি কি এবং কি ধরনের রাসায়নিক রয়েছে তার তালিকা চেয়ে ফার্মাকোলজি বিভাগে আগেই চিঠি দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে দীর্ঘ সময় ধরে তালাবদ্ধ থাকা রুমটিতে কি কি রয়েছে, তার সঠিক তথ্য দিতে পারেনি ফার্মকোলজি বিভাগ। প্রতি-উত্তরে কলেজ অধ্যক্ষ বরাবর প্রদত্ত চিঠিতে ফার্মাকোলজি বিভাগ জানায়, স্টোর রুমটি ১৯৬০ সাল থেকে তালাবদ্ধ। পরবর্তীতে এ তালা আর কখনো খোলা হয়নি। আর ওই সময়ে (১৯৬০ সালের আগে) স্টোর রুমে কি কি ছিল, তার রেজিস্টারেরও হদিস পাওয়া যায়নি। যার কারণে রুমটিতে কি কি রয়েছে, তার সঠিক তথ্য বিভাগে নেই।
স্টোর রুমে মজুদ থাকা রাসায়নিক (ক্যামিকেল) সংক্রান্ত তথ্য না পাওয়ায় রুমটির তালা খোলাটাও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে কলেজ প্রশাসন। ফলে এ বিষয়ে করণীয় ও মতামত জানতে চেয়ে ৫টি দপ্তরে চিঠি দেয় চমেক কর্তৃপক্ষ। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর ও গণপূর্ত বিভাগকে এ চিঠি দেয়া হয়। একই সাথে একটি কমিটি গঠনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একজন করে প্রতিনিধির নাম পাঠাতে অনুরোধ করা হয় চিঠিতে।
এসব দপ্তর থেকে ফিরতি চিঠিতে প্রতিনিধির নাম পাওয়ার পর অব্যবহৃত অবস্থায় থাকা এসব রাসায়নিক অপসারণে প্রাথমিকভাবে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। চমেক, পুলিশ, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত এ কমিটির আহ্বায়ক চমেকের ফার্মাকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সেফা সারওয়াত আলম।
কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সিএসবি শাখার সহকারী পুলিশ কমিশনার আতিক আহমেদ চৌধুরী, বিস্ফোরক পরিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. তফাজ্জল হোসেন, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (চট্টগ্রাম জোন-২) এর উপ-সহকারী পরিচালক ফরিদ আহাম্মদ চৌধুরী। আর কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আছেন চমেকের ফার্মাকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মাসুদ রানা। গঠনের পর গত ৬ ডিসেম্বর প্রথম সভা করে ৬ সদস্যের এ কমিটি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের একজন শিক্ষককে কমিটিতে কো-অপ্ট করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ওই সভায়। পরে আরো একাধিক বার সভা করে কমিটি। সর্বশেষ সভায় পরিবেশ অধিদফতরের নীতিমালা মেনে এসব রাসায়নিক অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানান কমিটির আহবায়ক ডা. সেফা সারওয়াত আলম। সভার সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।