বেশ কয়েক দফা সময় বাড়িয়েও শেষ করা যায়নি কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ভবন প্রকল্পের কাজ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৪২ এএম, ১৪ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:২৯ এএম, ২৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
বেশ কয়েক দফা সময় বাড়িয়েও শেষ করা যায়নি কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ভবন প্রকল্পের কাজ। আরো এক দফা ব্যয় ও সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। আর এতেই চটেছেন প্রধানমন্ত্রী। কেন সময়মতো কাজ শেষ হয়নি তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর নড়েচেড়ে বসেছেন সবাই। তবে অতীতের দুই প্রকৌশলীর অপকর্ম আর সমন্বয়হীনতার ফলেই ডুবেছে মেডিকেল কলেজ নির্মাণ প্রকল্প। তাই ২০১৬ সালের কাজ ২০২১ সালে এসেও শেষ হয়নি। সে সময় টেন্ডার করে ঠিকাদারদের অগ্রিম বিল দেয়া হলেও যথাসময়ে কাজ শুরু করতে না পারার বিষয় রয়েছে। একই সাথে ২০০৮ সালের ডিপিপি দিয়ে ২০১৩ সালের কাজ শুরু করার ফলে ব্যয় বেড়ে যায়। মূল সংকট সেখান থেকে শুরু। এরপর ফাইল চালাচালি আর তদন্তে দুই বছর বন্ধ থাকে কাজ। এখান থেকে বেরিয়ে এসে গত দেড় বছর ধরে জোরেশোরে কাজ শুরু হয়, যা প্রায় শেষের দিকে।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ২০১১ সালে মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (ম্যাটস) ভবনে অস্থায়ীভাবে যাত্রা শুরু হয় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের। আর ২০১৩ সালে শহরের লাহিনী এলাকায় ২০ একর জায়গার ওপর ২৭৫ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে নির্মাণ শুরু হয় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ভবন প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
মেডিকেল কলেজের একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে প্রকল্পের যে কাজ শুরু হয় তার ডিপিডি করা তৈরি করা হয় ২০০৮ সালে। সব কার্যক্রম শেষে যখন কাজ শুরু হয় তখন সব কিছুর বাজারদর বেড়ে যায়। তাই নকশা অনুয়ায়ী প্রতিটি ভবন শেষ না হলেও বরাদ্দকৃত অর্থ ফুরিয়ে যায়। পরিদর্শনে এসে আইএমইডি’র টিমের সদস্যরা অনিয়মের অভিযোগ এনে প্রতিবেদন দেন। এতে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তখন এ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন ডা. ইফতেখার মাহমুদ। তিনি একই সঙ্গে অধ্যক্ষ ছিলেন। সে সময় গণপূর্ত ও অধ্যক্ষের অবহেলার কারণেই কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ কয়েকজনকে সরিয়ে দেয়া হয়।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ‘২০১২ সালে যখন টেন্ডার আহবান করা হয় তখন কুষ্টিয়া গণপূর্তে নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন শাহিন মিয়া। তিনি তার সময় এক সাথে ৬টি ভবনের টেন্ডার করেন। টেন্ডার শেষে কাজ শুরু না হতেই অগ্রিম বিল দিয়ে দেন ঠিকাদারদের। ঠিকাদাররা অগ্রীম বিল পেলেও কাজ শুরু করেন আরো পরে। অভিযোগ আছে, এ জন্য ঠিকাদারদের কাছ থেকে তিনি ৫ কোটি টাকার বেশি কমিশন নিয়ে ঢাকায় পোস্টিং নেন। ১০ মাস ছিলেন তিনি।
এরপর যোগ দেন মোহাম্মদ শহিদ কবির। তিনি দায়িত্বে ছিলেন কয়েক বছর। তিনিও যোগ দিয়ে কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। ঠিকাদারদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে হাতিয়ে নেন কোটি টাকা। এই দুই প্রকৌশলী ডিপিপি ক্রয় পরিকল্পনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোটি কোটি টাকার লিমিটেড (এলটিএম) টেন্ডার করেন। ক্রয় পরিকল্পনায় ছিল প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহবান বা অপেন (ওটিম) টেন্ডার। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঠিকাদার নির্ধারণ করার কথা বলা হলেও এ প্রকৌশলীরা তা না করে যোগসাজশে লিমিটেড টেন্ডার করেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। এতে করে সরকারের খরচ বৃদ্ধি ও কোটি কোটি টাকা অপচয় হয়। তারাও হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে তখনকার নির্বাহী প্রকৌশলী শাহিন মিয়া বলেন, ‘তারা যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে টেন্ডার করেছিলেন। কোনো অনিয়ম হয়েছে বলে আমার জানা নেই। শাহিন মিয়া পদোন্নতি পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।’
সে সময় কাজের ধীরগতি ও যে বাজেট দেয়া হয় তা দিয়ে কাজ পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। ৬ তলা ভবনের জন্য যে বাজেট দেয়া হয়েছিল তা দিয়ে নির্মাণ করা হয় ৪ তলা ভবন। কারণ ২০০৮ সালের রেট দিয়ে ২০১৩ সালে কাজ শুরু করায় এ সমস্যা দেখা দেয়। তবে বিষয়টি গোপন রাখে তখনকার কয়েকজন প্রকৌশলী। বিষয়টি সরকারের দপ্তর আইএমইডি’র নজরে আনার কথা থাকলেও তা না করে কাজ চালিয়ে যায় ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা। এরপর আপত্তি দেয় পরিদর্শন করতে আসা। তারা অনিয়ম ও অদক্ষতা এবং নির্বাহী প্রকৌশলীদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। এরপর দুই বছর তদন্তে কেটে যায়। অর্থ ছাড়ও বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৮ সালে নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থ ছাড় করা হয়।
আর কাজ তদারকির দায়িত্বে আছেন মানিক লাল দাস। তিনি গণপূর্ত যশোর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এ কাজের সাথে থাকলেও সাইড পরিদর্শনে আসেন না ঠিকমত। এর আগে অবহেলায় যে ছাদ ধস হয় তাতে তারও অবেহলা ছিল বলে ধরা পড়ে। তবে অন্যরা শাস্তি পেলেও তিনি পার পেয়ে যান অর্থের জোরে। তার বিরুদ্ধে মেডিকেলের ঠিকাদারদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ আছে। এছাড়া অন্য ঠিকাদারদের যেখানে মেয়াদ শেষে সেখানে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিতর্কিত ঠিকাদার জহুরুল ইসলামের মেয়াদ তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন অর্থের জোরে। এই জহুরুলের কাজের সময় ছাদ ধসে পড়ে। পরে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হলেও তিনি পার পেয়ে যান আদালতে রিট করে। মেডিকেল কলেজের ঠিকাদারদের অর্থেই গাড়ি-বাড়িসহ নানা সম্পদের মালিক বনে গেছেন মানিক লাল দাস। এ প্রকৌশলী অর্থ পাচারের মতো ঘটনায় জড়িত বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। তিনি দ্বৈত নাগরিক বলেও জানা গেছে।
কথা বলে অনিয়মের বিষয়ে মানিক লাল দাস বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। সব কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি দ্বৈত নাগরিক নন বলেও দাবি করেন।
২০১৮ সালে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবনের গাড়ি বারান্দার ছাদ ধসের পর এ প্রকল্পের কাজ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দায়িত্বে অবহেলা ও অনিয়মের অভিযোগে গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী, এসডি, এসওসহ ৪ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়। দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বারবার হোঁচট খাওয়ার ফলে নতুন করে দায়িত্ব দেয়া তরুণ প্রকৌশলী আরিফুল ইসলামকে। সৎ কর্মকর্তা হিসেবে এ জেলায় তাকে পদায়ন করা হয়। এ কর্মকর্তা যোগ দেয়ার পর দ্রুত কাজ শেষ করার পদক্ষেপ নেন। একই সাথে প্রতিটি কাজের মান যাচাই করে বিল দেয়ার মত পদক্ষেপ নিয়েছেন। জানা গেছে, তার সময় পুরো চত্বরের বালু ভরাট কাজ, প্রাচীর নির্মাণ, একাডেমিক ভবন, ছাত্রছাত্রী হোস্টেল, চিসিৎসক ও নার্স ডরমেটরি ও মূল হাসপাতাল ভবনের কাজও প্রায় শেষ। এখন ফিনিশিং কাজ চলছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব ভবন হস্তান্তর করা সম্ভব বলেও জানা গেছে। ক্লাস করা ছাড়াও একাডেমিক কাজ চালানোর মতো পরিবেশ নিশ্চিত হয়েছে বলে গণপূর্ত সূত্র জানিয়েছে।
আগের একজন পিডি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কাজ যখন শুরু হয় তখনই অগোছালো ছিল। কাজের মানও ঠিক ছিল না অনেক সময়। নজরদারি না থাকায় ঠিকাদাররা শর্ত না মেনেইে অনেক কাজ করেছে। পরবর্তীতে গাড়ি বারান্দা ধসের পর এসব বিষয় সামনে আসে। তারপরও কঠোর নজরদারিতে আনা হয়।’
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ভবনের পিডি ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন করে জমি অধিগ্রহণ ও আরো কিছু ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আর আগের যেসব কাজ চলমান তা শেষের পথে। নতুন বছরেই নতুন ক্যাম্পাসে সব কার্যক্রম শুরু হবে বলে আমরা আশা করছি।’
কুষ্টিয়া গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘গত দেড় বছরে চেষ্টা করেছি কাজের মান শতভাগ ঠিক রেখে দ্রুত কাজ শেষ করতে। আমার সময়ে বেশির ভাগ শেষ হয়েছে। অনেক ভবন ব্যবহার উপযোগী করা হয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়েছে।’