ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষাতেও মিলছে না শিশু হাসপাতালের বেড
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৫০ এএম, ৫ অক্টোবর,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১২:৩৩ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। গত শনিবার দুপুরের তীব্র গরমে মূল ফটকের পাশেই ভ্যানে ডাবের দোকানে বেশ ভিড়। গেটের কিছুটা ভেতরে শিশুকে কোলে নিয়ে ‘উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা’ করছিলেন এক যুবক। চিন্তিত ওই যুবকের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, তিনি থাকেন ঢাকার দক্ষিণখান এলাকায়। তার কোলের শিশুর নাম ইয়াসিন, বয়স ১ মাস ১০ দিন। শিশুর জ্বর আসার পর এলাকার গলির ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে খাইয়েছেন। অবস্থার উন্নতি না হলে নিয়ে যান স্থানীয় এক হাসপাতালে। সেখান থেকেই জানতে পারেন শিশুটি নিউমোনিয়ায় ভুগছে। সেখানকার চিকিৎসকরা ইয়াসিনের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার শিশু হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দিয়েছেন। মো. সোহেল নামের ওই নিরুপায় বাবা চিকিৎসকের কথা মতো রাজধানীর শ্যামলীতে শিশু হাসপাতালে এসেছেন সকাল ১০টায়। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দুপুরের দিকে জানতে পারেন, সেখানে সিট নেই। সেখানকার কর্তব্যরতরা পাশের সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এখানেও সিট পাননি।
সোহেলের ভাষ্য, ‘বাচ্চারে নিয়া ঘুরতে ঘুরতে ওর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে এখানে আসলাম, এখন এখানেও নাকি সিট নাই। তাইলে বাচ্চারে নিয়া কই যামু আপা?’ শিশু হাসপাতালে গিয়ে সোহেলের কথার সত্যতা পাওয়া গেল। সেখানে ঢুকতেই দেখা হলো পঞ্চাষোর্ধ্ব নুরুন্নাহার বেগমের সঙ্গে। তিনি উত্তরা থেকে এসেছেন ১০ দিন বয়সী নাতনিকে নিয়ে। মেয়ে আর নাতনিকে নিয়ে অনেক সকালে এলেও দুপুর পর্যন্ত চিকিৎসককে দেখাতে পারেননি তিনি। কী সমস্যা জানতে চাইলে বললেন, ‘পাতলা পায়খানা, সঙ্গে জ্বর।’
শুধু সোহেল কিংবা নুরুন্নাহার নন, তাদের মতো বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকেই এসেছেন হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে। অনেকেই বহির্বিভাগের সামনে শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে বসে আছেন নির্ধারিত চেয়ারে, আবার কেউ জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। করোনাকালে তাদের ভিড় ঠেলে হাঁটার মতো অবস্থাও নেই। এমনকি সন্তানের অবস্থা খুবই জটিল হওয়ায় বহির্বিভাগের সামনে অক্সিজেন লাগিয়েও বসে থাকতে দেখা গেছে অভিভাবককে। আবার ঘন্টার পর ঘন্টা সন্তানকে নিয়ে অপেক্ষা করার পর টিকিট কাউন্টারে অভিভাবকদের মধ্যে হাতাহাতির মতো ঘটনাও ঘটেছে। পরে নিরাপত্তারক্ষীকে হস্তক্ষেপ করতে হয় সেখানে।
দেশে আশঙ্কাজনকহারে শিশুরা ঠান্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, মৌসুম বদলের এ সময়টিতে প্রতি বছরই শিশুদের এ অবস্থা দেখা যায়, প্রতি বছরই শিশু হাসপাতালের অবস্থা এমন থাকে। এ সময় জ্বর, বমি, পেট ব্যথা ও ডায়রিয়াতে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
ঢাকা শিশু হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত ২৫ সেপ্টেম্বর এ হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসা রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৬৬ জন, ২৬ সেপ্টেম্বর ১ হাজার ১১৪ জন, ২৭ সেপ্টেম্বর ৯২৩ জন, ২৮ সেপ্টেম্বর ১ হাজার ১২ জন, ২৯ সেপ্টেম্বর ৯২৩ জন, ৩০ সেপ্টেম্বর ৭৮৯ জন আর ১ অক্টোবর (শুক্রবার) রোগীর সংখ্যা ছিল ৩২৪ জন। এ সময়টিতে রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি বছরই এ সময়ে শিশু হাসপাতালে বেডের অপ্রতুলতা দেখা দেয়। একটা বেডের জন্য অভিভাবকদের আকুলতা ছুঁয়ে যায় চিকিৎসকদেরও। কিন্তু বেড না থাকলে তো তারা ভর্তি দিতে পারেন না। বেডের এই ভোগান্তিতে পড়েছেন ৯ মাস বয়সী নুসরাতের মা সুলতানা বেগমও। জ্বর, ঠান্ডা, কাশি নিয়ে তিন দিন ধরে ভোগা শিশুকে নিয়ে এসে ভর্তি করাতে পারেননি তিনি। তার কথায়, বাচ্চাটার জ্বরের কারণে খিঁচুনি উঠে যায়, মাথা তুলে রাখতে পারে না। এসেছি সকাল ৭টায়, কিন্তু এখনও ভর্তি করাতে পারিনি। বলছে বসে থাকতে। কতক্ষণ বসে থাকলে এটা সিট পাওয়া যাবে সেটাও জানি না।
সুলতানা বেগমের মতোই অপেক্ষায় আছেন রাজধানীর তেজগাঁও বেগুনবাড়ি থেকে এক মাস ছয় দিন বয়সী মিমকে নিয়ে বসে আছেন মা শিউলি খাতুন। কী সমস্যা জানতে চাইলে শিউলি খাতুন বলেন, ঠান্ডা-কাশি, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।
অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াচ্ছি, যা যা করতে বলছেন ডাক্তার, সবই করছি। কিন্তু কোনো পরিবর্তন নাই। রাতে শ্বাস ফেলাতে পারে না, এখন এখানে নিয়ে এলাম। ডাক্তার দেখছে, ভর্তি করতে বলেছে, কিন্তু সিট খালি নাই। বলছে, দুপুর ৩টা পর্যন্ত বসে থাকতে।
এখন বসে আছি সিটের আশায়, যদি পাওয়া যায়। শিশু হাসপাতালের উপ-পরিচালক ও মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, মৌসুম বদলের এ সময়টিতে ব্রংকিউলাইটিসের এ পিক হবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রতি বছরই শিশুদের আক্রান্তের হার এ অবস্থাতেই থাকে। আর তখন শিশু হাসপাতালে বেড থাকে না, এটা দীর্ঘদিনের অবস্থা, নতুন কিছু না। সারা বাংলাদেশ থেকে শিশুদের নিয়ে এ হাসপাতালে আসেন অভিভাবকরা। তাদের সবাইকে বেড দেয়া সম্ভব হয় না।
করোনাকালে হাসপাতালে রোগী সংখ্যা কম ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, সে সময় বহির্বিভাগে ৩০০ থেকে ৪০০ হতো, কিন্তু এখন সেটা এখন ৮০০ থেকে এক হাজার রোগী আসছে। হাসপাতাল হিমশিম খাচ্ছে রোগী সামলাতে। করোনার সময় প্রতিদিন যত রোগী আসতো, তার দ্বিগুণ কখনও কখনও তিনগুণ রোগী আসছে হাসপাতালে। ব্রংকিউলাইটিসের পিকটা শুরু হয়েছে গত এক সপ্তাহ ধরে, তখন থেকেই হাসপাতালের অবস্থা, বলেন তিনি। আবহাওয়ার তারতম্যের এই সময়টিতে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত এ অবস্থাই চলবে জানিয়ে ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, হাঁচি, কাশি, সর্দি, শ্বাসকষ্ট থাকে এ সময়। ডায়রিয়াতে আক্রান্ত রোগী এই মুহূর্তে তেমনটি না হলেও শীতের শুরুতে আবার ডায়রিয়ার পিক হবে।
অভিভাবকদের প্রতি পরামর্শ কী হবে জানতে চাইলে ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, ঋতু পরিবর্তনের এ সময়টিতে শিশুদের এরকম আক্রান্ত হওয়ার হার আগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই এ নিয়ে বিচলিত না হতে অনুরোধ করে তিনি বলেন, সামান্য জ্বর-সর্দি হতেই পারে। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল খাওয়ানো এবং গা মুছে দেয়ার পরার্মশ দিয়ে তিনি বলেন, আর সর্দি-কাশি হলে মধু-তুলসীপাতা, লেবু আদা চা খাবে, নাক পরিষ্কার করতে হবে সব সময় আর সন্তানকে রোদের সংস্পর্শে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যদি সন্তান খুব দুর্বল হয়ে যায়, নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হয় তখন অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর- এটা শিশুদের ঠান্ডা-কাশি-জ্বরের পিকটাইম জানিয়ে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, শিশুদের এই মৌসুমি জ্বরে আক্রান্ত হওয়াকে খুবই কমন। রোদ, বৃষ্টি ও ভ্যাপসা গরমের কারণে এটা হচ্ছে। অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, শিশুরা যেন বৃষ্টির পানি থেকে দূরে থাকে সেটা লক্ষ রাখতে হবে। ঘাম হলে দ্রুত সেটা মুছে দিতে হবে, দেরি করা যাবে না। সেই সঙ্গে অবশ্যই যেন এই মুহূর্তে আইসক্রিম, ফ্রিজের ঠান্ডা পানি থেকে তারা দূরে থাকে। সেই সঙ্গে সর্দি-কাশি হলে আদা-লেবু চা দিতে হবে।