হাসপাতালে ঠাঁই নেই : ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে রোগীদের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:০৩ এএম, ২৮ জুলাই,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৪২ পিএম, ১৫ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আঘাতে ভেঙ্গে পড়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত। প্রতিদিনই করোনায় মৃত্যু ও শনাক্তের সংখ্যা রেকর্ড ভাঙ্গছে।
আজ মঙ্গলবার সারাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ২৫৮ জনের। শনাক্ত হয়েছে ১৪৯২৫ জন রোগী।
করোনার উপসর্গ নিয়ে রোগীর চাপ অস্বাভাকিভাবে বেড়ে যাওয়া হাসপাতালগুলোতে সিট না থাকায় ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে রোগীদের। অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে রোগীরা। রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীর শহরগুলোর হাসপাতাল থেকে শুরু করে উপজেলা হাসপাতালগুলোর চিত্র একই রকম। করোনা উপসর্গ নিয়ে রোগীতে ভর্তি হয়ে গেছে হাসপাতালগুলো। বর্তমান এই পরিস্থিতির জন্য সরকারের উদাসীনতা এবং স্বাস্থখাতে সীমাহীন লুটপাটকে দায়ী করছে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক মহল। করোনার প্রথম আঘাতের পর দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাঝে যে সময়টুকু পেয়েছিলো তার সঠিক মূল্যায়ন না করায় চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। গতকাল সরজমিনের রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে দেখা যায় করোনা রোগীদের নিয়ে আত্মীস্বজনদের চরম দুর্ভোগের চিত্র। একটি আইসিউই বেডের জন্য ছুটতে হচ্ছে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। বেড খালি না পেয়ে হাসপাতলের সামনে অপেক্ষা করতে দেখে যায় রোগীদের।
রাজধানী ঢাকার অদূরে ভুলতা গাউছিয়া থেকে করোনা আক্রান্ত খোদেজা বেগমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন তার স্বজনরা। কিন্তু গত দুইদিন ধরে হাসপাতালে ঘুরেও তাকে ভর্তি করাতে পারেননি। খোদেজার ভাইসহ একাধিক আত্মীয় এ হাসপাতালে চাকরি করলেও বেড খালি না থাকায় ভর্তি করাতে পারছেন না তারা। শেষ পর্যন্ত প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট ভোগা খোদেজাকে ভাড়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডার এনে বাসায় রেখে কোনোভাবে চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করছেন তারা। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে ঢামেক হাসপাতাল-২-এর করোনা ইউনিটের সামনে দেখা গেল খোদেজাকে। অক্সিজেনের নল লাগিয়ে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে রাখা হয়েছে।
খোদেজার ভাই জানান, ‘আজ হয়তো একটা বেডের ব্যবস্থা হতে পারে এমন নিশ্চিত আশ্বাস পেয়ে তৃতীয় দিনের মতো বোনকে নিয়ে এসেছি।’
আজ দুপুর ১২টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মুগদা হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে অন্তত ১০ জন রোগী ফিরে গেছেন। এসব রোগী বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে শয্যা না পেয়ে এসেছিলেন মুগদা হাসপাতালে। কিন্তু এখানে আশাহত হয়ে ফিরতে হয়েছে তাদেরকে। মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হাসপাতালটিতে করোনা রোগীদের জন্য সবমিলিয়ে ৩৮৪টি শয্যা আছে। এরমধ্যে আইসিইউ শয্যা আছে ২৪টি। যার একটিও খালি নাই। এইচডিইউ ১০টি শয্যার একটিও খালি নাই। আর ডায়ালাইসিসের ১৬টি শয্যাও রোগীপূর্ণ। আর সাধারণ শয্যাগুলোও রোগীতে পূর্ণ।
হাসপাতাল সূত্র বলছে, জটিল রোগীদের জন্য কিছু শয্যা রাখা হয়েছে। জটিল রোগী আসলে ভর্তি নেয়া হচ্ছে। আর কোনো রোগী ছাড়পত্র নিয়ে চলে গেলে শয্যা ফাঁকা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, রাজধানীতে ১৬টি সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। এরমধ্যে তিনটি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা থাকলেও আইসিইউ নেই। এই তিনটি হাসপাতাল হলো সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতাল এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল।
বাকি ১৩টির মধ্যে সাতটিতে সোমবার পর্যন্ত কোনও আইসিইউ বেড খালি নেই। এই সাতটি হাসপাতালের মধ্যে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ২৬টি বেড, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ১০টি বেড, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৬টি বেড, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০টি বেড, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৪টি বেড, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০টি বেড ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০টি বেডের সবক’টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে।
এছাড়া অপর ৬টি হাসপাতালের মধ্যে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টি বেডের মধ্যে একটি, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টি বেডের মধ্যে ৫টি, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৮টি বেডের মধ্যে ২টি, টিবি হাসপাতালের ১৬টি বেডের মধ্যে ১২টি, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ১০টি বেডের মধ্যে ৫টি ও ডিএনসিসি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের ২১২টি বেডের মধ্যে মাত্র ২৩টি বেড ফাঁকা রয়েছে।
চট্টগ্রাম : বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল করোনা রোগীতে পূর্ণ হয়ে গেছে। গুরুতর অসুস্থ কোনো করোনা রোগীর জন্যও মিলছে না আইসিইউ বেড।
আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে মিলছে না একটি সাধারণ বেডও। হাসপাতালের ভর্তি করে ফ্লোরে রেখে অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। সকালে চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে করোনা চিকিৎসার এই হাহাকার চিত্র পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রামের করোনা রোগীদের জন্য একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতল ২৫০ শয্যার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল। এই হাসপাতালে করোনা ইউনিটে আইসোলেশন এবং অক্সিজেন সুবিধাসহ করোনা রোগীদের জন্য রয়েছে ১৫০টি বেড। কিন্তু এর বিপরীতে ভর্তি রয়েছেন ১৭০ জন। এই হাসপাতালের ১৭টি আইসিইউ বেডের একটিও খালি নেই।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জানিয়েছেন, অতিরিক্ত করোনা রোগীর চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ১৩১০ জন নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ১৮ জন।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম জানিয়েছেন. চট্টগ্রাম মেডিক্যালে ১০০ শয্যার করোনা ইউনিটের সক্ষমতা বাড়িয়ে ৩০০ শয্যা করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও রোগীর চাপ সামাল দেয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন ৩১৩ জন। খালি নেই একটিও আইসিইউ বেড।
চট্টগ্রাম মেডিক্যালের পর সবচেয়ে বড় বেসরকারি হাসপাতাল আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে করোনা ইউনিটে শয্যা রয়েছে ১৬২টি। ভর্তি রয়েছেন ১৭০ জন। এখানে ২০ শয্যার আইসিইউ বেডের একটিও খালি নেই।
একইভাবে চট্টগ্রামের বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে এভারকেয়ার হাসপাতাল, ম্যাক্স হাসপাতাল, সিএসসিআর, পার্ক ভিউ, মেট্রোপলিটন, ন্যাশনাল হাসপাতালসহ কোন হাসপাতালেই নতুন করে করোনা রোগী এবং আইসিইউতে রোগী ভর্তির সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন ঐসব হাসপাতালের কর্মকর্তারা।
চাঁদপুর : করোনা ও তার উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীতে ভরপুর চাঁদপুর আড়াইশ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল। রোগীর চাপ সামলাতে হাসপাতালের তৃতীয় তলায় নতুনভাবে করোনা ওয়ার্ড চালু করা হলেও সেখানেও কোনো শয্যা খালি নেই।
শয্যার অভাবে রোগীকে ফ্লোরে রেখেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। দিন যতই গড়াচ্ছে ততই চাঁদপুরে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ব্যাপকহারে বাড়ছে। এসব রোগীর চাপ সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের। বর্তমানে এ জেলায় করোনা পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতি হচ্ছে।
এ অবস্থায় সদর হাসপাতালের আইসোলেশনের বেড ৬০ থেকে ১২০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। তারপরও অতিরিক্ত রোগীর চাপে চিকিৎসক নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীদের গলদঘর্ম অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, এখন হাত ধোয়ার দিন শেষ। চিকিৎসাসেবায় গুরুত্ব দিতে হবে। কোনো হাসপাতালে বেড খালি নেই। ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে প্রাণহানি আরো বাড়বে। সামনে ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করছে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, মৃত্যু ও সংক্রমণ দুটিই বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে বেড বাড়িয়ে লাভ নেই। করোনার কমিউনিটি সংক্রমণ কমাতে হবে। একই সঙ্গে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যারা মাস্ক পরবে না, তাদের বয়কট করতে হবে, সম্মান করা যাবে না।