না’গঞ্জে আ’লীগ এমপি’র সেই ঘাতক জাহাজ মুক্তআসামিদের জামিন : মামলার বাদী জানেন না
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:৩৬ এএম, ২৬ মে,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:২৬ এএম, ২ অক্টোবর,
বুধবার,২০২৪
শীতলক্ষ্যায় পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবিয়ে দিয়ে ৩৪ প্রাণহানির ঘটনায় আটক আ’লীগ এমপি’র এসকেএল-৩ জাহাজটি ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বন্ডে মালিকের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে। একই সাথে এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার ১৪ জন আসামিও জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার (২১ মে) ও রবিবার (২৪ মে) পৃথক দুটি আদালতের আদেশে আসামিদের জামিন ও জাহাজের জিম্মা পায় মালিক। তবে এই বিষয়ে কিছুই জানেন না মামলার বাদী বিআইডব্লিউটিএর ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক বাবু লাল বৈদ্য। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা আ’লীগ নেতা ও আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন ও আদালত পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান।
পিপি বলেন, গত বুধবার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আসামিদের জামিন আবেদন করা হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতে জানান, লঞ্চডুবির ঘটনায় ক্ষতিপূরণ বাবদ ক্ষতিগ্রস্ত ৩০ জনের পরিবারকে ১ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪ জনের পরিবারের লোকজন ক্ষতিপূরণ নিতে রাজি হননি। তবে সকলেই তাদের আর কোনো দাবি-দাওয়া নেই বলে লিখিত দিয়েছেন। এই সংক্রান্ত কাগজপত্র আদালতে উপস্থাপন করা হলে বৃহস্পতিবার আদালত আসামিদের জামিন আদেশ দেন। এদিকে পুলিশ পরিদর্শক আসাদুজ্জামান বলেন, গত রবিবার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ূন কবিরের আদালত ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বন্ডে জাহাজটি মালিকের জিম্মায় প্রদান করার আদেশ দেন।
তবে ক্ষতিপূরণ গ্রহণের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লঞ্চডুবির ঘটনায় নিহত দুই বোন সাদিয়া ইভা (১১) ও লতার (১৯) বাবা দুখু মিয়া বলেন, একদিন এক আইনজীবী তাদের মোবাইলে কল করে মামলার বিষয়ে কথা বলতে নারায়ণগঞ্জ আসতে বলেন। পরে এক লাখ টাকা হাতে দিয়ে একটি কাগজে টিপসই নেন। তবে তাতে কী লেখা ছিল সে বিষয়ে কিছু জানেন না তিনি। তাদের ওই টাকা নেওয়া ও কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার পর আসামিদের জামিন ও জাহাজ মালিকের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে। এমনটা জানার পর দুখু মিয়া বলেন, এমনটা হইবো জানলে তো আমরা টাকা নিতাম না। আমরা এই ঘটনার সুবিচার চাই।
গত ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় মুন্সিগঞ্জগামী এম এল সাবিত আল হাসান লঞ্চটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয় এসকেএল-৩ (রেজিস্ট্রেশন নং: ০১-২৬৪৩) নামে কার্গো জাহাজটি। জাহাজটি বাগেরহাট-২ আসনে আওয়ামী লীগের এমপি শেখ সারহান নাসের তন্ময়ের মালিকানাধীন এসকে লজিস্টিকস নামক প্রতিষ্ঠানের। লঞ্চডুবির ঘটনায় ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে বিআইডব্লিউটিএর ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক বাবু লাল বৈদ্য অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। মামলার পর ৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে ১৪ স্টাফসহ জাহাজটিকে আটক করে কোস্টগার্ড। পরে জাহাজটিকে জব্দ ও স্টাফদের গ্রেফতার দেখায় মামলার তদন্তকারী সংস্থা নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ থানা পুলিশ। জাহাজটির বেপরোয়া গতি ও নৌ রুট সংকীর্ণ হওয়ার কারণে লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটেছিল বলে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল। এমনকি জাহাজটির চলাচলেরও অনুমোদন ছিল না।
জাহাজটি গত সোমবার সকাল পর্যন্তও নারায়ণগঞ্জের সেন্ট্রাল খেয়াঘাট সংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদীতে নোঙর করা ছিল। স্থানীয়রা জানান, দুপুরের পর থেকে জাহাজটি আর তারা দেখছেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ থানার ওসি শহিদুল আলম জানান, সকালে জাহাজটির মালিকপক্ষ আদালতের আদেশের কাগজ নিয়ে আসেন। ওই কাগজে জাহাজটি মালিকপক্ষের জিম্মায় দেওয়ার কথা লেখা রয়েছে। পরে জাহাজটি তাদের জিম্মায় দেওয়া হয়। তবে এতে তদন্তে কোনো সমস্যা হবে না।
তবে আসামিদের জামিন ও জাহাজ জিম্মায় দেওয়ার বিষয়ে কিছুই জানতেন না বলে দাবি মামলার বাদী বিআইডব্লিউটিএর ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক বাবু লাল বৈদ্যের। তিনি বলেন, জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার পর বিষয়টি আমি জানতে পেরেছি। আদালতের মাধ্যমে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। কত টাকা বন্ডে জাহাজের জিম্মা পেয়েছেন বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে তা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তবে এ বিষয়ে আমি খোঁজ নিচ্ছি।
এদিকে আসামিদের জামিন ও জাহাজটি মালিকের জিম্মায় চলে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ডুবে যাওয়া লঞ্চের কেরানি মঞ্জুরুল ইসলাম। ঘটনার দিন ওই লঞ্চেই ছিলেন তিনি। সাঁতরে কোনোমতে প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন। ঘটনার পর তিনি মামলা করতে চেয়েছিলেন। তবে তিন থানা ঘুরেও মামলা করতে পারেননি বলে অভিযোগ তার। তিনি বলেন, আমি নিজেও ওই লঞ্চে ছিলাম। আমি নিজেও মারা যেতে পারতাম। আল্লাহ প্রাণ রক্ষা করছেন। অথচ আমরা মামলা করতে গেলে আমাদের মামলা কোনো থানায় নেওয়া হইলো না। সদর-বন্দর-নৌ থানায় ঘুরছি। কেউ মামলা নেয় নাই। সর্বশেষ মেরিন কোর্টে গিয়ে মামলা করতে গেলাম। সেখানে আবেদন রাখা হইছিল। লকডাউনের কারণে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। আগামীকাল যাবো মেরিন কোর্টে খোঁজ নিতে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থার সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বাদল বলেন, এমনটা হবে আগেই জানতাম। কার্গোর মালিকানার সঙ্গে ক্ষমতাসীন ব্যক্তির সম্পর্ক থাকার কারণে বিআইডব্লিউটিএর এমন নিরবতা। এ ব্যাপারে মানবাধিকার কর্মী অ্যাড. মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, এটা পুরোপুরি রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতা। ঘটনার দু’মাসও পার হয়নি অথচ আসামিরা জামিন পেল, জাহাজটিও মালিকের জিম্মায় চলে গলে। কিন্তু এই ঘটনা লঞ্চমালিকপক্ষ জানে না, বাদীও জানে না। এটি বাজে একটি উদাহরণ হিসেবে থাকবে।