কঠোর লকডাউনের উদ্দেশ্য সফল হওয়া নিয়ে সংশয়
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৩০ এএম, ১৬ এপ্রিল,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০১:২১ এএম, ১৪ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২৪
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকারঘোষিত ‘সর্বাত্মক লকডাউনের’ দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার। লকডাউনের প্রথম দিনের চেয়ে এদিন ঢাকার রাস্তায় মানুষের সমাগম কিছুটা বেড়েছে। দিনের প্রথম ভাগে সীমিত পরিসরে ব্যাংক খোলা থাকবে। লেনদেন চলবে পুঁজিবাজারেও। এছাড়াও জরুরি পরিষেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিস খোলা থাকছে। প্রথম দিনের চেয়ে দ্বিতীয় দিন রাস্তায় পুলিশের অবস্থান তুলনামূলক কম দেখা গেছে। সকালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুলিশ চেকপোস্টগুলো প্রথম দিনের চেয়ে দ্বিতীয় দিন কিছুটা নমনীয় ভাব।
সর্বাত্মক কঠোর লকডাউনে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল করছে। রাতে পার হচ্ছে মালবাহী গাড়ি। আর ২৪ ঘণ্টাই জরুরিসেবার আওতায় রোগী ও লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের সাথে সমানে পার হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ি। একইসাথে ফেরিতে গাদাগাদি করে যাত্রী পারাপারও অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধিও সঠিকভাবে নামা হচ্ছে না। ফলে কঠোর লকডাইনের উদ্দেশ্য সফল হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। দেশব্যাপী শুরু হওয়া কঠোর লকডাউনের দ্বিতীয় দিন গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। এ সময় স্থানীয় ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকগুলো রাতে ফেরি পার হবে। প্রতিরাতেই ট্রাক পারাপার করা হয় বলেও জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
দেশে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর বুধবার থেকে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউন। এর এক সপ্তাহ আগে দেশে লকডাউন ঘোষণা হলেও তা কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে। তাই ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য শুরু হয় কঠোর লকডাইন। কিন্তু কঠোর লকাডাউন শুরুর আগে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া প্রান্তে আটকা পড়ে তিন-চার শ ট্রাক। আটকে পড়া ওইসব ট্রাকে পচনশীল পণ্যও রয়েছে। যা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো রাতে পারাপারের অনুমতি পেয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নদী বন্দর কর্তৃপক্ষ- বিআইডব্লিউটিসি। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে দৌলতদিয়া ঘাট বিআইডব্লিউটিসির ব্যবস্থাপক ফিরোজ খান আরো জানান, সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণার পর বুধবার ভোর থেকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় সব ধরনের যানবাহন পারাপার বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধু লাশ ও রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স পারাপার করা হচ্ছে। তাও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে।
অবশ্য বাস্তব চিত্র অনেকটা ভিন্ন। সরেজমিনে দেখা গেছে, দিনের বেলায় লাশবাহী ও রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স পারাপারের সাথে ব্যক্তিগত গাড়ি আর যাত্রীরাও ফেরিতে পার হচ্ছে পদ্মা।
এদিকে দিনে পার না করায় দৌলতদিয়া প্রান্তে সড়কে ট্রাকের লম্বা লাইন তৈরি হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে ভোর রাত পর্যন্ত এসব ট্রাক পার করা হবে। ট্রাকের সাথে ব্যক্তিগত বা অন্য যানবাহন পারাপার হবে কি না- জানতে চাইলে ঘাটের কর্মকর্তা ফিরোজ খান বলেন, এটা প্রশাসনের ব্যাপার। ‘প্রশাসন অনুমতি না দিলে হবে না’।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, কঠোর লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ব্যক্তিগত যানবাহন ফেরিতে পারাপার হচ্ছে। প্রতিটি গাড়িতে গাদাগাদি করে পার হচ্ছেন ঘরমুখো মানুষ।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাট ম্যানেজার ফিরোজ বলেন, ‘সীমিত আকারে ফেরি চলাচল করছে। তবে ঘাট থেকে ফেরি ছাড়ার আগে গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুমতি নেয়া হয়।
প্রথম দিন যেসব চেকপোস্টে পুলিশ বেশ কঠোর মনোভাব দেখিয়ে প্রায় প্রতিটি গাড়ি আটকে যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, আজ তেমনটা দেখা যায়নি। তবে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে সব রাস্তায় চলাচল করা যাচ্ছে না। লকডাউনের প্রথমদিন পহেলা বৈশাখের ছুটি থাকায় সবকিছু বন্ধ ছিল। ফলে মানুষ ঘর থেকে কম বের হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দিন গতকাল বৃহস্পতিবার ব্যাংক, শেয়ারবাজার, পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা। ফলে সকাল থেকে রাস্তায় গাড়ির চলাচলও বেড়েছে কিছুটা। সকাল সাতটা থেকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের দলে দলে তাদের কর্মস্থলে যেতে দেখা গেছে। শ্রমিকদের অনেকেই তাদের কারখানার আশপাশের এলাকায় বসবাস করায় তাদের পরিবহনের তেমন প্রয়োজন হয়নি। ফলে হেঁটেই কর্মস্থলের দিকে রওনা হয়েছেন। সর্বাত্মক লকডাউনে ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত সারাদেশে সব ধরনের অফিস ও গণপরিবহন, বাজার-শপিংমল, দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ প্রভৃতি বন্ধ থাকবে। তবে জরুরি সেবার প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকবে। খোলা থাকবে শিল্প-কলকারাখা। সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং সেবাও খোলা থাকবে। এই সময়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া যাবে না। খোলা স্থানে কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যদি কেনাবেচা করা যাবে ৬ ঘণ্টা। এর আগে ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বিধিনিষেধ দেয়া হলেও সেটি মোটেও কার্যকর হয়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বুধবার থেকে কঠোর লকডাউন কার্যকর করতে সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে তা বাস্তবায়নে এবার কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা। কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হলে পুলিশের পক্ষ থেকে মুভমেন্ট পাস নিয়ে বের হওয়ার নিয়ম চালু করা হয়। এর উদ্দেশ্য ‘অনিয়ন্ত্রিত ও অপ্রয়োজনীয়’ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা এবং জরুরি বিশেষ প্রয়োজনে যাতায়াতের সুবিধা রাখা।
বুধবার কঠোর লকডাউন শুরুর প্রথম দিন সকাল থেকেই রাজধানীজুড়ে কড়াকড়ি অবস্থা ছিল। সর্বাত্মক লকডাউনের প্রথমদিনে ঢাকার রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকলেও অলিগলিতে অনেককে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। তাদের বেশিরভাগই বের হয়েছিলেন খুচরা জিনিসপত্র এবং কাঁচাবাজারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে ঢাকার রাস্তায় মানুষের চলাচল বেশি দেখা গেছে। ব্যাংক ও পোশাক কারখানা খোলা থাকায় এই চলাচল বেড়েছে। তারা মুভমেন্ট পাস নিয়েই ঘর থেকে কাজে বেরিয়ে পড়েছেন। পুলিশ বলছে, রাজধানীর বৃহত্তর পাইকারি কাঁচাবাজার হওয়ায় কারওয়ান বাজার এলাকায় লোকসমাগম বেশি হয়। তবে মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়ে বাইরে আসা মানুষদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সন্তোষজনক উত্তর দিলেও বেশিরভাগই দেখাচ্ছেন খোঁড়া অজুহাত। ফলে কাউকে ফেরত পাঠাতেও দেখা গেছে।
লকডাউন দেখতেও বের হচ্ছে মানুষ : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার যখন সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে, চলছে কঠোর লকডাউন। ঠিক তখনও কিছু মানুষ কোনো প্রয়োজন ছাড়াই বাইরে বের হচ্ছেন লকডাউন দেখতে। কোনো কাজ না থাকা সত্ত্বেও সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে রাস্তায় বের হচ্ছেন, কেউ কেউ খালি সড়কে তুলছেন সেলফি।
এমন মানুষদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। লকডাউনের প্রথমদিন থেকেই এমন মানুষদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পটুয়াখালী শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, যারা বাইরে বের হয়েছেন তাদের অনেকেরই তেমন কোনো কাজ নেই। অতি উৎসাহী মন নিয়ে কেমন চলছে লকডাউন তা দেখতেই তারা বের হয়েছেন। লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে লকডাউনের পরিস্থিতি পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ জানান, জেলা শহরের সর্বত্র পুলিশের কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করা হয়েছে। বাইরে বের হওয়ায় সবাইকেই পুলিশের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তবে মানুষের মধ্যে অনেকটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে। আগামী সাত দিন পুলিশের এই কঠোর আবস্থান থাকবে বলেও জানান তিনি। পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে জেলার প্রবেশদ্বার লেবুখালী ফেরিঘাট, পায়রাকুঞ্জ, চৌরাস্তাসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে বলেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। এরপরও যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়া যারা বাইরে বের হয়েছে তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে।
মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর সাধারণ মানুষকে নিরাপদ রাখতে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছে। মার্চের শেষ দিক থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত করোনাভাইরাস এবং স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত বিষয়ে জেলায় মোট ১৭২টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। যাতে মোট মামলা হয়েছে ১৪০৫টি। এতে ১৪০৪ জন ব্যক্তির কাছ থেকে ৫২৮৯৪০ টাকা জরিমানা আদায় এবং একজনকে কারাদন্ড প্রদান করা হয়।