ধুনটে কলেজের জমি স্ত্রীর নামে দলিল করে নিলেন আ’লীগ নেতা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:০৩ এএম, ১০ মার্চ,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০২:১৬ পিএম, ২৪ নভেম্বর,রবিবার,২০২৪
বগুড়ার ধুনট উপজেলার বিলচাপড়ী আইডিয়াল কলেজের ১৫ শতক জমি নিজের নামে এবং স্ত্রীর নামে দলিল করে নিয়েছেন ধুনট উপজেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল আওয়াল। কলেজ ফান্ডের টাকা দিয়ে কলেজের নামে জমি কেনার কথা থাকলেও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আ’লীগ নেতা রবিউল আওয়াল ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নিজের নামে এবং তার স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করে নেন। একারণে প্রায় ৩ কোটি টাকার ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে।
গতকাল সোমবার বিকেলে কলেজ ক্যাম্পাসে এক সংবাদ সম্মেলনে অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম সহ প্রায় ১০/১২ জন শিক্ষকবৃন্দ এ অভিযোগ করেন। তবে আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল আওয়াল ও তার স্ত্রী নাজনীল নাহার সভাপতি থেকে শুধু কলেজের জমিই নেননি, ওই কলেজে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েও প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। জানা গেছে, ধুনট উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নের বিলচাপড়ী বাঙ্গালীর নদীর পশ্চিমপাড়ে ১৩২ শতক জমিতে ২০০০ সালে বিলচাপড়ী আইডিয়াল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
২০০৪ সালে পাঠদানের অনুমতি পেলেও দীর্ঘদিনেও এমপিভুক্ত হয়নি কলেজটি। ২০০৯ সালে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ওই কলেজের সভাপতি হন ধুনট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল আওয়ালের স্ত্রী একই দলের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমান বগুড়া জেলা পরিষদের সদস্য নাজনীল নাহার। নাজনীল নাহার ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ওই কলেজের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর স্ত্রীকে বাদ দিয়ে ২০১৩ সালে কলেজের সভাপতির পদ কেড় নেন নাজনীল নাহারের স্বামী রবিউল আওয়াল। তিনি ২০১৯ সাল পর্যন্ত ওই কলেজের সভাপতি পদ আকড়ে রেখে একক আধিপত্য কায়েম করেন।
অভিযোগ রয়েছে, তারা স্বামী-স্ত্রী একই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ১০ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে কলেজের ১৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে প্রায় এক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তবে তাদের দাবিকৃত আরো অতিরিক্ত টাকা না দেওয়ায় শিক্ষকদের ব্যাংক চেকও আটকে রেখেছেন রবিউল আওয়াল। আ’লীগ নেতা রবিউল আওয়াল ও তার স্ত্রী নাজনীল নাহার ওই কলেজে শুধু নিয়োগ বাণিজ্যই করেননি, এমনকি কলেজ ফান্ডের টাকা দিয়ে কলেজের নামে জমি না কিনে নিজেদের নামে জমি কিনেছেন তারা। বিলচাপড়ী আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম জানান, এই কলেজটির ক্যাম্পাসের জন্য ১৫ শতক জমি ক্রয় করতে ২০১৬ সালে নাজনীল নাহারের ভাগিনা জমির মালিক রবিউল হাসান উৎসবের সঙ্গে চুক্তি হয়। কিন্তু কলেজের তৎকালীন সভাপতি আ’লীগ নেতা রবিউল আওয়াল কলেজের নামে জমি রেজিস্ট্রি না করে তার নিজ নামে ৯ শতক এবং তার স্ত্রীর নামে ৬ শতক জমি উৎসবের কাছ থেকে কৌশলে রেজিস্ট্রি করে নেন। তবে তারা পরবর্তীতে কলেজের নামে ওই জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়ার কথা থাকলেও দীর্ঘদিনেও তা করেননি। এমতাবস্থায় ওই কলেজে ভবন নির্মাণের জন্য প্রায় ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। কিন্তু সম্প্রতি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওই কলেজের ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করতে গেলে রবিউল হাসান উৎসব ও তার খালু রবিউল আওয়াল কলেজ ক্যাম্পাসের জমি তাদের দাবি করে ভবন নির্মাণ কাজে বাধা দেয়। একারণে ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে।
তিনি আরো জানান, তার এসব অনিয়ম ও দুর্র্নীতির কারণে ২০২০ সালে ম্যানেজিং কমিটিতে আমজাদ হোসেন নামে এক ব্যক্তি সভাপতি নির্বাচিত হন। এতে রবিউল আওয়াল আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। একারণে তিনি রীতিমতো প্রতিটি শিক্ষককে হুমকি-ধামকিসহ কলেজের জায়গা দখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। কলেজের জীব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সাবিনা খাতুন জানান, ২০১৬ সালে ৭ লাখ টাকার বিনিময়ে তাকে নিয়োগ দিয়েছেন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আ‘লীগ নেতা রবিউল আওয়াল। কিন্তু রবিউল আওয়ালের চাহিদা ছিল আরো দুই লাখ টাকা। তবে তার দাবিকৃত টাকা না দেয়ায় ব্যাংক চেকও আটকে রাখেন রবিউল। এছাড়া কলেজের সকল শিক্ষক নিয়োগের রেজুলেশন খাতাও তিনি জোর করে নিয়ে গেছেন। এছাড়া একই ভাবে কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ দিতে মমনী খাতুনের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আব্দুল লতিফের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা এবং প্রভাষক নজরুল ইসলামের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা সহ ১৫ শিক্ষকের কাছ থেকে প্রায় ১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আ’লীগ নেতা রবিউল আওয়াল ও তার স্ত্রী নাজনীল নাহার। এদিকে আ‘লীগ নেতা স্বামী রবিউল আওয়াল যখন কলেজের সভাপতি, তখন স্ত্রী নাজনীল নাহার বগুড়া জেলা পরিষদের সদস্য। তাহলে এই সুযোগটাই বা কাজে লাগাবেন না কেন স্ত্রী। ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে বিলচাপড়ী আইডিয়াল কলেজ উন্নয়নের নামে বগুড়া জেলা পরিষদের এডিপি প্রকল্পে দুই দফা ২ লাখ টাকা করে মোট ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ নেন আ‘লীগ নেত্রী নাজনীল নাহার। কিন্তু সেই বরাদ্দে মাত্র ২০/২৫ হাজার টাকায় একটি ল্যাট্রিন এবং মাত্র ৩০ হাজার টাকায় কলেজ গেটের দুইটি পিলার নির্মাণ করে অবশিষ্ট টাকাও আত্মসাৎ করেন।
কলেজের নবনির্বাচিত কমিটির সভাপতি আমজাদ হোসেন বলেন, কলেজের সকল ফান্ডই তসরুপ করেছেন সাবেক সভাপতি রবিউল আওয়াল। এমনকি তিনি কলেজের টাকা দিয়ে নিজের নামে এবং স্ত্রীর নামে কলেজ ক্যাম্পাসের জমিও রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। তার বাধার কারণে কলেজের ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। তাই এবিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
ধুনট উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মহসীন আলম জানান, ২০১৯ সালের ১৩ আগস্ট রবিউল আওয়াল মাদক পরিবহনকালে ৩৮ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ দিনাজপুর জেলার হাকিমপুর থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এঘটনায় আওয়ামী লীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়।
তবে এসব বিষয়ে কলেজের সাবেক সভাপতি ও ধুনট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) রবিউল আওয়াল তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তার বিরুদ্ধে রজনৈতিক ষড়যন্ত্র চলছে। তবে তিনি তার নিজের টাকায় জমি কিনেছেন বলে দাবি করেন।
এবিষয়ে ধুনট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার মহন্ত বলেন, এসব বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।