হাসপাতালের ওষুধ পাচারের ছবি তোলায় সাংবাদিক অবরুদ্ধ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৩৭ এএম, ৮ মার্চ,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:৫১ এএম, ২১ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২৪
সরকারি হাসপাতালের বিপুল পরিমাণ ওষুধ পাচারের খবর পেয়ে সংবাদকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে ছয়টি বস্তাভর্তি ওষুধ পাচারের ছবি তোলায় ক্ষিপ্ত হয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং আবাসিক মেডিকেল অফিসার। তাদের নির্দেশে হাসপাতালের দুটি গেট তালাবদ্ধ করে ১০ জন সংবাদকর্মীকে প্রায় দুই ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরবর্তীতে খবর পেয়ে অন্যান্য সংবাদকর্মী ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানাপুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে রাত সাড়ে ১০টার দিকে অবরুদ্ধ সাংবাদিকদের উদ্ধার করেছেন। ঘটনাটি ঘটেছে গত শনিবার দিবাগত রাতে জেলার গৌরনদী উপজেলা হাসপাতালে। অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় সংবাদকর্মীদের ফেসবুক লাইভে বিষয়টি দেখে হাসপাতাল কম্পাউন্ডে এলাকার শত শত মানুষ জড়ো হয়ে রাতেই অভিযুক্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং আবাসিক মেডিকেল অফিসারকে প্রত্যহারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ইউএনও’র সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস পুরো ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দিয়ে রাত ১টার দিকে উত্তেজিত এলাকাবাসীকে শান্ত করেন।
জানা গেছে, গত শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ৮টার দিকে উপজেলা হাসপাতালের পাশের নির্জন স্থানে বিপুল পরিমাণ ওষুধ পোড়ানো ও পাচারের খবর পেয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। এ সময় সংবাদকর্মীরা দেখতে পান ছয়টি বস্তা ভর্তি সরকারি ওষুধ হাসপাতাল থেকে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছেন আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মাজেদুল হক কাওসার ও তার বহিরাগত ৪-৫ জন সহযোগী। এ সময় সংবাদকর্মীরা ছবি তুলতে গেলে মাজেদুল হক কাওসার ও তার সহযোগীরা পাচারের উদ্দেশ্যে নেয়া ২০২২ সাল পর্যন্ত মেয়াদের বেশকিছু সরকারি ওষুধ ফেলে পালিয়ে যায়। কিছু সময় পর সংবাদকর্মীরা হাসপাতাল ত্যাগ করতে গিয়ে দেখতে পায় হাসপাতালের দুটি গেট তালাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিক বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অবহিত করেন অবরুদ্ধ সংবাদকর্মীরা। ইউএনও ঘটনাস্থলে পৌঁছে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে থাকেন। পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাত সাড়ে ১০টার দিকে তালা খুলে দেয়ার পর অবরুদ্ধ সংবাদকর্মীরা মুক্ত হন। পরবর্তীতে ইউএনও’র নির্দেশে থানাপুলিশ তল্লাশি চালিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আমরুল্লাহ এবং আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মাজেদুল হক কাওসারের হাসপাতাল কোয়ার্টারের বাসার পাশের ঝোঁপজঙ্গলের মধ্য থেকে বস্তাভর্তি পাচার করা সরকারি ওষুধ ও ইনজেকশন জব্দ করেন। যার প্রত্যেকটির মেয়াদ রয়েছে আগামী ২০২২ সাল পর্যন্ত।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার জন্য অভিযুক্ত চিকিৎসকদের পক্ষালম্বন করে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে। এলাকাবাসীর দাবি, সরকারের মহতী উদ্যোগে গ্রামের অসহায়, দুস্থদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ বরাদ্দ করা হলেও গৌরনদী উপজেলা হাসপাতাল থেকে কোনো ওষুধ সরবরাহ করা হয় না। কারণ বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ লিখলে ওই কোম্পানির প্রতিনিধিদের মাধ্যমে চিকিৎসকদের মোটা অংকের টাকা কমিশন দেয়া হয়। সরকারের নেয়া মহতী উদ্যোগ মøান করার ফলে হাসপাতালে বরাদ্দকৃত বেশকিছু ওষুধের ডেট ওভার হয়ে গেছে। বাকি ডেট থাকা ওষুধ ও ইনজেকশন বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকের মাধ্যমে ব্যবহার করিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্যই পাচার করা হচ্ছিল। এ ব্যাপারে অভিযুক্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আমরুল্লাহ নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, স্টোরকিপার ডেট ওভার কিছু ওষুধ পুড়িয়ে ফেলেছে। বস্তাভর্তি পাচার করা (ডেট থাকা) সরকারি ওষুধ উদ্ধার এবং সাংবাদিকদের জিম্মি করে রাখার ব্যাপারে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মাজেদুল হক কাওসার পুরো ঘটনার দায়ভার স্টোরকিপার সাইদুল ইসলামের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে নির্দোষ সাজানোর চেষ্টা করেন। তবে সাংবাদিকদের ধারণ করা ভিডিও ফুটেজে ঘটনাস্থলে তার (মাজেদুল কাওসার) উপস্থিত থাকার ব্যাপারে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। সার্বিক বিষয়ে গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, সংবাদকর্মীদের অবরুদ্ধের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি বেশকিছু সরকারি ওষুধ জব্দ করা হয়। যার অধিকাংশরই ডেট রয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক তদন্তে হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, গত শনিবার দিবাগত রাত ৮টা ২৩ মিনিটে হাসপাতাল থেকে অসংখ্য ওষুধের কার্টন ট্রলি ভর্তি করে বাইরে নেয়া হচ্ছে। পুরো ঘটনাটি সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করার পাশাপাশি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে তার বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অপরদিকে গ্রামের অসহায়, দুস্থদের জন্য জনবান্ধব সরকারের বরাদ্দ করা সরকারি ওষুধ পাচারের ছবি তুলতে গিয়ে হাসপাতালের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার রোষানলে সাংবাদিকদের অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বরিশালের সাংবাদিক সমাজ। অনতিবিলম্বে অভিযুক্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং আবাসিক মেডিকেল অফিসারকে প্রত্যাহারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা না হলে সাংবাদিকরা তীব্র আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।