কম খরচে বেশি লাভ, পতিত জলাবদ্ধ জমিতেই কৃষি বিপ্লব!
পানিফল চাষে সুদিন ফিরছে কৃষকদের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭:৫৯ পিএম, ২ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৪:১৮ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলায় কৃষকদের মাঝে বৃদ্ধি পেয়েছে মৌসুমি পানিফল (স্থানীয় ভাষায় ‘পানি সিঙ্গারা’ নামে পরিচিত) চাষে। এরই মধ্যে লাভজনক এই ফল চাষ করে পরিবারের সুদিন ফিরেছে অনেক প্রান্তিক চাষির। উপজেলার জলাবদ্ধ পতিত জমিতে এখন শোভা পাচ্ছে পানিফলের গাছ।
প্রতিদিন ভোরে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা যাত্রীবাহি বাস, ভ্যানগাড়ি, ইজিবাইকের মাধ্যমে বস্তায় ভরে এই পানিফল বিক্রির জন্য নিচ্ছেন জেলা সদর, যশোর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন বাজার গুলিতে। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ট্রাক যোগে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে। এছাড়া কলারোয়া পৌরসদরের মুরারীকটি থেকে যুগিবাড়ী পর্যন্ত সাতক্ষীরা-ঢাকা মাহাসড়কের দুইপাশে সারিবদ্ধভাবে পানিফল বিক্রি করছে স্থানীয় কৃষকরা।
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শুভ্রাংশ শেখর দাস বলেন, পানিফল একটি বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। উপজেলায় চলতি বছর প্রায় ৩৮ হেক্টর পতিত জমিতে পানিফল চাষ হয়েছে। পানিফলের পুষ্টিরমান অনেক বেশি। কলারোয়া উপজেলার পতিত জমিতে এই পানিফলের চাষ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মুলত কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় এ ফল চাষে আগ্রহী হচ্ছে এখানকার কৃষকেরা। প্রতিবছর বোরো ধান কাটার পর, জলাবদ্ধ পতিত জমি, পানি জমে থাকা ডোবাসহ খাল-বিলে এই ফলের লতা রোপণ করা হয় (জমে থাকা পানিতে)। তিনি বলেন, তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের মধ্যে গাছে ফল আসে। এ ফল চাষে সার-কীটনাশকের তেমন প্রয়োজন হয় না।
খোঁজনিয়ে জানাগেছে, বর্তমানে বাজারে পাইকারি ভাবে প্রতি কেজি পানিফল প্রকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৪০/৪৫ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ৫০/৫৫ টাকা দরে। এদিকে ডোবা আর বদ্ধ জলাশয়, পতিত জমিতে পানিফল চাষ করে পরিবারের সুদিন ফিরেছে উপজেলার দুই শতাধিক হতদরিদ্র কৃষকের। এদিকে, স্থানীয় পানিফল চাষি কৃষকরা জানান, কলারোয়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে পানিফল চাষ শুরু হয়। কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় দিনে দিনে এই চাষে আগ্রহী হচ্ছেন দরিদ্র প্রান্তিক কৃষকরা। কৃষকদের দাবি, কলারোয়ায় পানিফল চাষে সফলতা পাওয়ায় দেশের অন্যান্য উপজেলার চাষিরা অনুপ্রাণিত হয়ে এমনকি অনেকে সরজমিনে এসে চাষাবাদ পদ্ধতি শিখে তাদের পতিত জমিতে চাষ শুরু করছেন।
পৌরসদরের মুরারীকাটি গ্রামের চাষী পানি ফল চাষী আজিবর গাজাী দৈনিক দিনকালকে জানান, অল্প খরচে অধিক লাভ হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে পানি ফলের চাষ। সুস্বাদু এ ফলটি জলাবদ্ধ এলাকায় পতিত জমিতে খুব সহজেই চাষ করা যায়। এছাড়া অল্প খরচ করে উৎপাদন বেশি ও লাভজনক হওয়ায় পানি ফলের চাষে ঝুঁকছে এখানকার চাষীরা। তিনি বলেন, ফলটি বাজারে তৈরি সিঙ্গারার মতো দেখতে হওয়ায় স্থানীয় ভাষায় ‘পানি সিঙ্গারা’ নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছে।
পানিফল চাষী তৌহিদুর রহমানসহ কয়েক কৃষক বলেন, ১৪ বছর ধরে কলারোয়া পৌর সদরের গোপিনাথপুরে পতিত ও জলাবদ্ধ জমিতে পানিফল চাষ করে আসছেন। পানি ফলে সার কীটনাশকের তেমন প্রয়োজন হয় না। অন্যান্য ফসলের থেকে এর পরিচর্যাও কম। এছাড়া অল্প খরচে লাভ অনেক বেশী। খেতেও সুস্বাদু।
কৃষক ওসমান গানি বলেন, এবছর তাঁর ৬বিঘা জমিতে পানিফল চাষে খরচ হয়েছে প্রায় ৭২ হাজার টাকা। এরইমধ্যে পানি ফল বিক্রি হয়েছে ১লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এখনও জমিতে ফল রয়েছে, আশা করছি এবার ৬বিঘা জমিতে প্রায় ১লাখ ৭০ হাজার টাকার ফল বিক্রয় হবে। তিনি আরও বলেন, অন্যান্য ফসলের থেকে পানিফল চাষে দ্বিগুণ লাভ হচ্ছে। ফলে স্থানীয় কৃষকদের মাঝে এই ফল চাষে আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
কলারোয়া যুগিবাড়ী গ্রামের কৃষক আজিজুল ইসলাম জানান, মুরারীকাটি পতিত জমিতে ৪ বিঘা পানিফল চাষ করেছেন , বর্তমানে ফল তুলে বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, গত মৌসুমে খরচ বাদে পানিফল চাষ করে ৯৫ হাজার টাকা লাভ করেছি। এবার ফলন ও বাজারমূল্য দুটোয় ভালো। তাই গতবারের চেয়ে বেশি লাভের আশা করছি।
এদিকে পানিফল চাষী আবুল হোসে, কাদের, শিল্পি খাতুন, কবিরুল ইসলাম, আকরম আলীসহ অধিকাংশ কৃষকরা জানান, সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে ঋণ সহায়তা পেলে আরো অনেক প্রান্তিক কৃষকরা পানিফল চাষের সুযোগ পাবে। ফলে একদিকে নিজেরা যেমন স্বাবলম্বী হতে পারবে ঠিক তেমনই গ্রামীণ অর্থনীতিতেও অবদান রাখা সম্ভব হবে এমনটাই দাবি করেন এসব কৃষকেরা।
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শুভ্রাংশ শেখর দাস দৈনিক দিনকালকে জানান, বর্তমানে পানিফল কৃষিতে নতুন এক সম্ভাবনাময় ফসল। আমাদের কৃষি বিভাগ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে পানিফল চাষের বিস্তার ঘটাতে। যে কোন পতিত পুকুর, ডোবা অথবা জলাশয়ে পানিফল চাষ করা সম্ভব। তুলনামূলক এর উৎপাদন খরচ কম। তিনি বলেন, চলিত বছর প্রায় ৩৮ হেক্টর জমিতে পানিফল চাষ করা হয়েছে। যা আগামী বছর বৃদ্ধি পেয়ে আরো বেশি জমিতে চাষ হবে বলে তিনি মনে করেন।
দিনকাল/এমএইচআর