কুমিল্লায় হারিয়ে গেছে বর-কনের বাহন ‘পালকি’
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭:২৬ পিএম, ২ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৫:১২ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
কুমিল্লা দক্ষিনাঞ্চলের লাকসাম, লালমাই, বরুড়া, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা জুড়ে একটা সময় খাঁন ও বিহারী সম্প্রদায় কিংবা বেহারাদের নানাহ গানের সুরে সুরে বিয়ে অনুষ্ঠানে বর-কনের একমাত্র বাহন ছিলো গ্রামবাংলার চিরায়ত জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী পালকি। কিন্তু চলমান প্রযুক্তির ঢামাঢোলে আজ সবই যেনো হারিয়ে গেছে। কালের আর্বত্তে শুধু অতীত স্মৃতি হয়ে কল্পনায় ভাসছে সেই মধুর দিনগুলো।
এ অঞ্চলে অবস্থানরত পশ্চিমাদেশের বিহারী সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্মের একধিক সূত্র জানায়, কালের আর্বত্তে আমাদের পূর্ব পুরুষদের পেশা ছিলো এ পালকি দিয়ে বিয়ে অনুষ্ঠানে বর-কনে পারাপারের বাহন। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে এখন আর পালকি পেশা নাই। দাদা-পিতার মৃত্যুর পর আমরা পালকির এ পেশার দিকে না ঝুঁকে অন্য পেশা নিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছি। ওইসময় দেখা যেতো বিয়ে অনুষ্ঠানে বর-কনেকে কাঁধে নিয়ে বরের বাড়ী থেকে কনের বাড়ী অথবা কনের বাড়ী থেকে বরের বাড়ী পালকি নিয়ে যাওয়ার অপরূপ দৃশ্য এবং সে সাথে পালকি বেহারার কণ্ঠে নানাহ গান শুনা যেতো। রাস্তা দিয়ে বর কনে আসছে শুনে ঘর থেকে বের হয়ে আসতো এ অঞ্চলের ছেলে-মেয়েরা। এখন আর সে দৃশ্য না বললেই চলে। পালকির সামনে- পিছনে বর-কনের ৬/৭ জন স্বজন আর মাঝখানে বেহারা দু’জন মধুর কণ্ঠে গান গেয়ে ছুটে চলতো গন্তব্যের স্থলে। এ ভাবেই বহন করা হতো বিয়ে অনুষ্ঠানে বর-কনেকে পালকি নামক বাহন দিয়েই।
সূত্রগুলো আরও জানায়, জেলা দক্ষিনাঞ্চল তথা বৃহত্তর লাকসামের বানিজ্যিক নগরীখ্যাত লাকসাম দৌলতগঞ্জ নোয়াখালী রেলগেইটের উত্তর পাশে সারি সারি ভাবে থাকতো পালকি ও বেহারার দল। তখনকার সময় প্রায়ই ৩০/৩৫টি ওই সম্প্রদায়ের পরিবার পালকি বাহন পেশায় জড়িত ছিলো। কিন্তু এখন আর তাদের ওই পেশার অস্তিত্ব বলতে কিছুই নেই। তবে পালকি বাহন পেশার সাথে জড়িতদের এ অঞ্চলের মানুষ বেহারা বলে চিনতো। লাকসাম পৌরশহরের একটি পাড়ায় এখনও ঘরের চালের সাথে ভাঙ্গাচুড়া পালকি বাহনটি সংযুক্ত সরঞ্জামসহ তুলে রাখার চিত্র পাওয়া যায়। আবার অভাবের তাড়োনায় কেউ কেউ পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় এবং কেউ কেউ চলে গেছেন বিভিন্ন শহরে কিংবা নিজ জন্মস্থান পশ্চিমাদেশে।
স্থানীয় বয়ঃবৃদ্ধদের একাধিক সূত্র জানায়, এ পেশার সাথে জড়িত বেহারা পরিবারগুলো ছিলো অনেকেটাই অভাবী পরিবার। বাংলা নববর্ষে বিয়ের মৌসুম আসলেই বিয়ে অনুষ্ঠানে বর-কনে বহন করতে পালকি ছাড়া বিকল্প কোনো বাহন ছিল না। মাসে ৮/১০টি বিয়ের ভাড়া দিয়েই চলতো তাদের সংসার। বছরের বেশির ভাগ সময় তারা বসে বসে দিনগুনতো কখন কোন এলাকার লোকজন এসে পালকি বায়না করবে। অথচ আজ সব কিছু যেনো অতীত। নতুন প্রজন্মের কাছে পালকির গল্পটা যেন একটা ইতিহাস। ১৯৯০ সালের পূর্বে এ বাহন পালকির ভাড়া প্রতিটা ৫’শত টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত গন্তব্য এলাকা বুঝে দর হাঁকাতো তারা। আনন্দ-উল্লাস করে এলাকার মানুষদের কেউ কেউ ওইসময় পালকি ভাড়া নিয়ে থাকতো। বিয়ে অনুষ্ঠান ব্যাতিত বেহারারা পালকি ভাড়ায় যেতো না। ৯০ দশকের পর প্রযুক্তিযুগে দেশ অনেকটাই এগিয়ে গেলেও গ্রাম-বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য পালকির কদর এখন আর নেই।
এ ব্যাপারে পালকি ব্যবসার সাথে জড়িত বিহারী কিংবা খাঁন পরিবার সম্প্রদায়ের লোকজন এবং পালকি বেহারাদের স্বজনদের কাছ থেকে বার বার চেষ্টা করেও কোনো তথ্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
দিনকাল/এমএইচআর