আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ রুহুল আমিনের খোঁজ নেয়নি কেউ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:৫০ পিএম, ১৮ অক্টোবর,শুক্রবার,২০২৪ | আপডেট: ০৪:২৫ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে সুচিকিৎসার অভাবে তিন মাস ধরে বিছানায় কাতরাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের বাসিন্দা রুহুল আমিন। তার এ অবস্থায় চরম আর্থিক সংকটে পড়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছে পুরো পরিবার।
আহত রুহুল আমিন ও তার পরিবারের দাবি, এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি এবং কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তাও পাননি তারা। গুলিবিদ্ধ রুহুল আমিন, শুয়ে বসে কোনো রকমে দিন পার করছেন বাড়িতে, নেই কোনো আয়, বিপাকে পুরো পরিবার।
আজ শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) দুপুরে রুহুল আমিনের বাসায় গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত ও সুস্থ সবল মানুষটি হুইলচেয়ারে নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন তা কল্পনাও করেননি পরিবারের সদস্যরা। হুইলচেয়ারই এখন রুহুল আমিনের চলাফেরার একমাত্র ভরসা। এ ছাড়া বাকি সময় কাটছে বিছানায় শুয়ে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে।
স্বজনরা জানান, নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার লাধুরচর গ্রামের রুহুল আমিন গত এক যুগ ধরে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের মুক্তিনগর এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন। বড় ছেলে মো. রনি এসএসসি পরীক্ষার্থী ও ছোট ছেলে ইসমাঈল হোসেন নিরব মাদ্রাসায় লেখাপড়া করছে। সবজি ব্যবসায়ী রুহুল আমিনের স্বল্প আয়ের ওপরই নির্ভরশীল তার পুরোপরিবার।
শয্যাশায়ী রুহুল আমিন জানান, গত ২০ জুলাই সকালে ব্যবসার কাজে পৈতৃক বাড়ি সোনারগাঁ যান তিনি। কাজ শেষে বিকালে বাসায় ফেরার পথে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কাঁচপুর সেতুর নিচে সোনারগাঁয়ের সেনপাড়া এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষের মাঝখানে আটকা পড়েন তিনি। চারপাশে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে ভয়ে ও আতঙ্কে নিজেকে রক্ষা করতে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হন।
রুহুল আমিন বলেন, গোলাগুলির সময় ভয়ে আর আতঙ্কে আমি যখন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিলাম ঠিক সেই মুহূর্তে আচমকা রাইফেলের একটি গুলি আমার ডান পায়ের হাঁটুর নিচে বিদ্ধ হয়। তখন আমি রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। গুলিটি দুটো হাঁড় ভেঙে পায়ের অপর পাশ দিয়ে মাংস ভেদ করে বেরিয়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন আমাকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালে নিলেও তাৎক্ষণিক কোথাও আমি চিকিৎসা পাইনি। পরে আমার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরা আমাকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করলেও চিকিৎসা চলে ধীর গতিতে। দুটি অপারেশ করা হলেও উন্নত চিকিৎসার অভাবে তেমন কোনো সুফল আমি পাইনি। পা আদৌ ভালো হবে কি না, এ নিয়ে শঙ্কায় আছি।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী রুহুল আমিনের এমন অবস্থায় আর্থিক সংকটের কারণে বাসাভাড়া তিন মাসের বকেয়াসহ দুই ছেলের লেখাপড়াও বন্ধ হওয়ার পথে। চিকিৎসার খরচও জোগাতে হচ্ছে ধারদেনা করে। তাই রুহুল আমিনের চিকিৎসা ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাতে হচ্ছে।
গুলিবিদ্ধ রুহুল আমিনের স্ত্রী পারুল আক্তার বলেন, এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আমার স্বামীকে দেখতে আসে নাই। কেউ কোনো খোঁজখবরও নেয়নি। মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা করে কয়দিন চিকিৎসা করানো যায়? মানুষ কয়দিন ধার দিবে?’
ছলছল চোখে পারুল আক্তার বলেন, আমার স্বামী সুস্থ না হলে আমাদের পরিবারের হাল ধরার মতো আর কেউ নেই। তিন মাসের বাসাভাড়া দিতে পারতেছি না। দুই ছেলের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারতেছি না। কীভাবে আমাদের দিন চলবে এই নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছি। সরকার যদি আমার স্বামীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করত, তিনি যদি হাঁটতে পারতেন তাহলে আমাদের পরিবারটির একটা গতি হতো। কারো কাছে সাহায্য চাইতে হতো না।’
রুহুল আমিনের বড় ছেলে রনি বলেন, এবার আমার এসএসসি পরীক্ষা দেবার কথা। কিন্তু স্যারের কাছে পড়ার বেতন ও পরীক্ষার ফি দিতে পারতেছি না। আব্বু সুস্থ না হলে আমার ও আমার ছোট ভাইয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। তাই সরকারের কাছে আমার আকুল আবেদন আমার আব্বুর চিকিৎসার ব্যবস্থা যেন তারা করেন। অসহায় পরিবারটির প্রতি সুনজর দিতে সরকারের কাছে সহযোগিতা কামনা করছেন রুহুল আমিনের নিকট আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা।
বিষয়টি জানতে পেরে গুলিবিদ্ধ রুহুল আমিনের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন থেকে আমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে চোখে গুলিবিদ্ধ যুবক মাহাবুবসহ দুজনকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছি। রুহুল আমিনের বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। আমরা আহতদের তালিকায় তার নাম সংযোজন করবো। এ ছাড়া আর্থিক সহায়তাসহ তার সুচিকিৎসার ব্যাপারেও আমরা সহযোগিতা করব।
উল্লেখ্য, গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় আহত রুহুল আমিন ১৭৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয় আরও ৬০ জনকে আসামি করে গত ১৫ সেপ্টেম্বর সোনারগাঁ থানায় মামলা করেছেন।
দিনকাল/এসএস