আ'লীগকে নিয়ে ‘কৌতুক’ : ১৭ বছরের কিশোরের নামে মামলা, ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:১৬ এএম, ১৩ অক্টোবর,রবিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৬:২১ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
২০১৭ সালের ২৭ মে। আব্দুল মুকিত রাজুর বয়স তখন ১৭ বছর। ওইদিন ‘আওয়ামী লীগ’ শব্দ নিয়ে বাবা-ছেলের কথোপকথন সংবলিত কৌতুক ফেসবুকে পোস্ট করার অভিযোগ করেন দলটির এক স্থানীয় নেতা। এ অভিযোগে পরদিন আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় রাজশাহীর পবা থানায় মামলা হয়। এ মামলায় ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি মুকিতকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মো. জিয়াউর রহমান।
মামলা হওয়ার পর গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান মুকিত। পরে জামিনে মুক্ত হন। তবে ২০২২ সালে রায় হওয়া পর থেকে এখনো তিনি কারাগারে আছেন। মুকিতের আইনজীবীরা জানান, ফেসবুকের একটি স্ক্রিনশটের আলোকে তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অথচ ওই স্ক্রিনশটটি যে মুকিত দিয়েছিলেন, সেটি প্রমাণিত হয়নি।
জানা গেছে, মুকিত কোরআনের হাফেজ। জেলে অবস্থানকালে সেখান থেকে পরীক্ষা দিয়ে তিনি পাস করেছেন ফাজিল (স্নাতক) ও কামিল (স্নাতকোত্তর)। গত ৩ অক্টোবর তার কামিল পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। তিনি জিপিএ-৩.৫০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এরই মধ্যে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়ের আইসিটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত অনেকেই মুক্তি পেয়েছেন। তবে মুকিতের জামিন না হওয়ায় দিনমজুর বাবা আক্ষেপ করেন।
জানা গেছে, মুকিত রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর গ্রামের মো. রিয়াজুল ইসলামের ছেলে। বাবা-মায়ের পাঁচ মেয়ে ও একমাত্র ছেলে মুকিত। তিনি ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি সাইদুর রহমান বাদল আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় ২০১৭ সালের ২৮ মে রাজশাহীর পবা থানায় মুকিতের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিলেন। বাদীর অভিযোগ ছিল, আসামি নিজের ফেসবুক আইডির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ব্যঙ্গ করেছেন।
মুকিতের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ ধরনের কৌতুকের কারণে কোনো রাজনৈতিক দলের মানহানির সুযোগ আছে বলে তারা মনে করেন না। এ ছাড়া তিনিই যে এই পোস্টটি দিয়েছেন, এটির প্রমাণ হয়নি।
আইনজীবীরা বলেন, রাজনৈতিক দল নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা কিংবা ব্যঙ্গ-কৌতুক এগুলো গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত বিষয়। এজন্য তারা উচ্চ আদালতে আপিলও করেছিলেন। তবে তার জামিন হওয়া সত্ত্বেও আইনি জটিলতার কারণে তিনি এখনো মুক্তি পাননি।
মুকিতের আইনজীবী মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি সংগঠন। আর মানহানি মামলা হয় কোনো ব্যক্তির মানহানি কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজ করলে। আর সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হতে পারে। কিন্তু পোস্টের স্ক্রিনশট নিয়ে মামলা হয়েছিল সেটি রাষ্ট্রদ্রোহেরও কোনো বিষয় নয়। এ ছাড়া পোস্টটি অবশ্যই বাকস্বাধীনতার মধ্যেই পড়ে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ফেসবুকের একটি স্ক্রিনশট নিয়ে মামলা হয়েছিল। অথচ এমন কোনো পোস্টই তিনি ফেসবুকে দেননি। কেননা, আসামির মোবাইল জব্দ কিংবা ফরেনসিক টেস্টও হয়নি। এটি এডিট কি না তাও প্রমাণ করা হয়নি। এ ছাড়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মোবাইল নম্বরটিও যাচাই-বাছাই করা হয়নি। সুতরাং ফেসবুকে পোস্টটি মুকিতের নয়। অথচ তিনি মিথ্যা মামলায় সাজাভোগ করছেন। ২০১৭ সালের ২৭ মের যে স্ক্রিনশট নিয়ে মামলাটি হয়েছিল, তখন মুকিতের বয়স ছিল ১৭ বছর। সাজার সময় তার বয়সও বিবেচনা করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ‘মুকিতের ১০ বছরের সাজা হওয়ার পর এটি নিয়ে ওই সময় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। এই রায়ের বিপক্ষে উচ্চ আদালতে আপিল করলে ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি জামিনও পান। কিন্তু ওই বছরের ২০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন মামলা স্টে করে দেন। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি আপিল বিভাগ সেই স্টে বহাল রাখেন এবং আপিল নিষ্পত্তি করতে বলেন। কিন্তু পরে আপিল নিষ্পত্তি না করেই গত ২ সেপ্টেম্বর ফের তার জামিন দেওয়া হয়। তবে আপিল বিভাগ ফের তার সেই জামিন বাতিল করেন। ফলে এখনো তিনি কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
আব্দুল মুকিতের মা আশরাফুন্নেছা বলেন, ‘ছেলের বাবা স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে নাইটগার্ডের কাজ করেন। আমার পাঁচ মেয়ে ও একমাত্র ছেলে মুকিত।
অনেক আশা ছিল, ছেলে পড়ালেখা করে কিছু করবে। তার বৃদ্ধ দিনমজুর বাবার কষ্টটা একটু দূর হবে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী সরকারের মিথ্যা মামলায় একমাত্র ছেলের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। ফ্যাসিবাদী সরকার পালিয়েছে। তবে আমার ছেলে এখনো জেলে। মিথ্যা মামলা থেকে আমার ছেলে যেন দ্রুত মুক্তি পায়, তার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।’