বেকার চেয়ারম্যান থেকে কটিপতি, কিনেছেন আড়াই কোটি টাকার ফ্ল্যাট
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:০৫ পিএম, ১ ফেব্রুয়ারী,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:১৭ পিএম, ২৪ নভেম্বর,রবিবার,২০২৪
চলাচলে রিকশা আর সাইকেলই যার ছিলো ভরসা, সেই জানে আলম ইউপি চেয়ারম্যান হয়েই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। দামী গাড়ি আর বিলাসবহুল বাড়ি- ফ্ল্যাট, জমিসহ অর্ধশত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন কয়েক বছরের মধ্যেই। জানে আলমের বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার নেপথ্যে দরিদ্র মানুষের টাকা আত্মসাতসহ নানা দুর্নীতি এবং অনিয়মের তথ্য উপাত্ত উঠে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে।
দুদক থেকে জানে আলমের বিরুদ্ধে মামলাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হলেও অজ্ঞাত কারনে এখনো মামলা করেনি দুদক। কি কারণে দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান জানে আলমের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করছে না, সেই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে চলমান একটি রিট পিটিশন মামলায় আদালতও ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জানে আলমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা জারি করা হয়।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের আওতায় মৃত ব্যক্তি, পুলিশ কনষ্টেবল, প্রধান শিক্ষক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রবাসী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, গ্রাম পুলিশসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ভুয়া একাউন্ট খুলে সরকারের কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইউজিপিপি) প্রকল্পের টাকা হাতিয়ে নেয় ইউপি চেয়ারম্যান জানে আলমসহ একটি সিন্ডিকেট। এরমধ্যে ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরের শ্রমিকের তালিকায় নাম থাকা ৪১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরিফ উদ্দিন। দুদকের দীর্ঘ অনুসন্ধানেও উঠে এসেছে জানে আলমের ভয়ংকর দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণাদি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হতদরিদ্রদের তালিকায় নাম আছে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির দাঁতমারা ইউনিয়নের জেবুন্নেছাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মোমিন মজুমদার,বালুটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শাহজামাল মজুমদার, দাঁতমারা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আব্দুস শুক্কুর, পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত কনষ্টেবল সালাউদ্দিন সজিব, ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রবাসী ফাহাদ আলীসহ সচ্ছল ব্যাক্তিদের। ওই তালিকায় শিক্ষক, পুলিশ, রাজনীতিবিদসহ বিত্তবানদের নাম উঠিয়ে এবং ভুয়া ব্যাংক হিসাব বানিয়ে চেয়ারম্যান জানে আলম ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তরিকুল ইসলামসহ একটি সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছেন দরিদ্র মানুষের লাখ লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে আরো দেখা গেছে, তালিকার ৪১ জনের কেউই শ্রমিক নয়। তাদের প্রত্যেকেই স্বাবলম্বী। যাদের কেউই এসব টাকা উত্তোলন করেননি কিংবা টাকা সংগ্রহ করতে ব্যাংক একাউন্টও খোলেননি তারা। বরং শ্রমিকের তালিকায় অর্ন্তভুক্তদের অধিকাংশই ভুয়া। শুধু তাই নয়, এসব মজুরি শ্রমিকদের হিসাবে জমা করার কথা থাকলেও ওই টাকা না দিয়ে ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে জমা করেন চেয়ারম্যান জানে আলম। এরমধ্যে শুধুমাত্র ফটিকছড়ির হেঁয়াকো শাখার বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রকল্পের একাউন্ট থেকে ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৯৬৬ টাকা স্থানান্তর করে নিজ একাউন্টে রাখা হয়। যার মধ্যে ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর ৫ লাখ ২১ হাজার টাকা শ্রমিকদের হিসাব থেকে উত্তোলন করে দুইদিন পর ব্যক্তিগত একাউন্টে রাখেন তিনি।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার আগে নিজস্ব কোন ব্যবসা ছিলো না জানে আলমের। করেননি কোন চাকরিও। তবুও তিনি অর্ধশত কোটি টাকার মালিক। ভাঙ্গা বাড়ি থেকে এখন থাকছেন চট্টড়গ্রাম নগরীর সুগন্ধা আবাসিক এলাকার আড়াই কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। ৭ বছরে চার ব্যাংকে লেনদেন হয়েছে ৭ কোটি ২৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। নগদে রয়েছে ৪ কোটি টাকা। এতসব কিছুরই মালিক দরিদ্র মানুষের টাকা লুটে নেয়া ওই ইউপি চেয়ারম্যান জানে আলম। যিনি দুই মেয়াদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরই গড়েছেন এসব সম্পদের পাহাড়।
এদিকে, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণীর দাখিলের নির্দেশ জারি করেছে দুদক। একই সাথে সরকারের কর্মসৃজন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের দালিলিক প্রমাণও পাওয়া গেছে দুদকের দীর্ঘ অনুসন্ধানে। যার বিষয়ে আত্মসাতকৃত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।
শুধু তাই নয়- দুদকের অনুসন্ধান শেষে ২০২০ সালের ৩ অক্টোবর দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মাহমুদ হাসানের সই করা এক চিঠিতে জানে আলমসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশসহ প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। দুদকের ওই চিঠিতে বলা হয়, চেয়ারম্যান জানে আলম ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তরিকুল ইসলামসহ ৫ জনের সিন্ডিকেট জালিয়াতি এবং প্রতারণার মাধ্যমে দরিদ্রদেও কর্মসৃজন প্রকল্পের টাকা আত্মসাত করার তথ্য প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১১ সালের ১১ জুন প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জানে আলম। ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিলেও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। দুদকের অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগেও জানে আলম ব্যবসা-বাণিজ্য কিছু করতেন না। তবে চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন কোটিপতি।
অভিযোগ- চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের তারাকো বন বিটের আওতাধীন বনের জমি দখলে নিয়ে মানুষ থেকে অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জন করেছেন। গড়েছেন বিপুল সম্পদও। এর মধ্যে নগরীর সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় এএনজেড প্রোপার্টিজ লিমিটেড থেকে বিলাসবহুল একটি ফ্ল্যাটের তথ্য পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। পাওয়া গেছে চারটি ব্যাংক একাউন্টে থাকা প্রায় ১১ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন। দুদকের ধারণা, সবগুলো অর্থই অবৈধভাবে অর্জন করেছেন তিনি।
দুদক সুত্রে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংক ফটিকছড়ি শাখাতেই ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা। ফটিকছড়ির হেঁয়াকো শাখার প্রাইম ব্যাংকের একটি একাউন্টে মাত্র তিন বছরের অর্থাৎ ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালে লেনদেন হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এছাড়া, নগরীর লালদীঘির পূবালী ব্যাংকের একটি একাউন্টে চেয়ারম্যানের নামে আছে প্রায় চার কোটি টাকা এবং ফটিকছড়ির হেঁয়াকো শাখার বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে নিজ একাউন্টে লেনদেন হয়েছে ২ কোটি ৭৬ লাখ ৫৪ হাজার ৭৫ টাকা। এরমধ্যে ২০১১-২০১২ থেকে ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরের প্রকল্পের ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৯৬৬ টাকা হস্তান্তর হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে দুদকের অনুসন্ধানে।