দুর্গাপুরে সরকারি জলমহাল ইজারা নিতে ভুয়া কাগজপত্র দাখিলের অভিযোগ যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৩৬ এএম, ২০ জানুয়ারী,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০১:৩৭ এএম, ১৫ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
রাজশাহীর দুর্গাপুর পৌর এলাকার শালঘরিয়া মৌজার একটি জলমহাল (বিল) ইজারা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এস এ শাখা থেকে জলমহালটি (বিল) ইজারার জন্য ইজারা বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে। এরপর থেকেই জলমহালটি (বিল) ইজারা নিতে দুর্গাপুর উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ছালিমুদ্দিন ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে একটি চক্র গোপনে বিভিন্ন জায়গায় দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
এর আগেও ওই চক্রটি ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে নামমাত্র মূল্যে জলমহালটি ইজারা নিয়েছিলেন। জলমহালটির বার্ষিক ইজারা মূল্য দেখানো হয়েছে এক লাখ ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা। সে হিসেবে ৩ বছরে ইজারা মূল্য দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকায়। পরবর্তিতে ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে জলমহালটি ইজারা নেয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সায়রাত অধিশাখা-১ থেকে ইজারাটি বাতিল করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ১৩ ডিসেম্বরে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এস এ শাখা থেকে দুর্গাপুর পৌর এলাকার শালঘরিয়া মৌজার ২০.৩৬ একর (৬১ বিঘার উপরে) আয়তনের ওই জলমহালটি (বিল) ১৪২৮ হতে ১৪৩০ সন পর্যন্ত সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০০৯ অনুসারে ইজারা দেয়ার জন্য বৈধ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির কাছ থেকে ইজারা আহ্বান করে ইজারা বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। যার বার্ষিক ইজারা মূল্য দেখানো হয়েছে এক লাখ ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা। সে হিসেবে ৩ বছরে ইজারা মূল্য দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকায়। প্রথম দফায় ইজারা আবেদন ক্রয়ের শেষ দিন ছিল ৩০ ডিসেম্বর। আর ইজারা দরপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল ৩১ ডিসেম্বর। শেষ দিনে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সায়রাত অধিশাখা-১, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় মিলে মোট ৯টি দরপত্র জমা পড়ে।
যে ৯টি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির পক্ষ থেকে দরপত্র জমা দেয়া হয়েছে সেসব সমিতিগুলোর অধিকাংশ সমিতিরই কাগজপত্র ঠিক নাই মর্মে অনুসন্ধানে জানা গেছে। দরপত্র দাখিল করা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি গুলো হচ্ছে, শালঘরিয়া ডাহার বিল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ, শালঘরিয়া পূর্বপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ, কিসমত হোজা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ, শালঘরিয়া মালঞ্চ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ, দেলুয়াবাড়ি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ, দেবীপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ, দেবীপুর ডার বিল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ, কাশিমপুর পাবলই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ ও ক্ষিদ্র লক্ষিপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিঃ। এর মধ্যে শালঘরিয়া ডাহার বিল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিটি প্রকৃত মৎস্যজীবীদের নিয়ে গঠন করা হয়নি মর্মে জানা গেছে।
এছাড়া দুর্গাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় থেকে এই সমিতির নামে ১৪২৭ হতে ১৪২৯ বাংলা সন মেয়াদে দুইটি পুকুর ইজারা নেয়া হয়েছে। শালঘরিয়া পূর্বপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিও প্রকৃত মৎস্যজীবীদের নিয়ে গঠন করা হয়নি মর্মে কাগজপত্র অনুসন্ধান করে জানা গেছে। এই সমিতির বেশিরভাগ সদস্যই জানেন না তারা এই সমিতির সদস্য। এছাড়া এই সমিতির সদস্য মিজানুর, মাসুম, মাহাবুর, জয়নাল, সাঈদ, সাহাবুল ও আজমল হোসেন শালঘরিয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও এদের শালঘরিয়া পূর্বপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য দেখানো হয়েছে। এই সমিতিটি জেলা সমবায় অফিস থেকে অডিট বরাদ্দ না থাকা সত্ত্বেও দুর্গাপুর উপজেলা সমবায় অফিস থেকে অডিট সম্পাদন করে প্রত্যয়ন নেয়া হয়েছে। কিসমত হোজা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিটি প্রকৃত মৎস্যজীবীদের নিয়ে গঠন করা হয়নি। এই সমিতির ১২ নম্বর ক্রমিকে সদস্য হিসেবে রয়েছেন জেলা পরিষদের সদস্য ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মান্নান ফিরোজ, ১৪ নম্বর ক্রমিকে সদস্য রয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক ও ১৫ নম্বর ক্রমিকে সদস্য রয়েছেন উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান শরিফ। এই তিন জনেরই মৎস্যজীবীর কার্ড নেই মর্মে কাগজপত্র অনুসন্ধান করে জানা গেছে। এই সমিতির অডিট প্রতিবেদনে বর্ণিত তালিকা অনুযায়ী ১১ জন সদস্যকে কোনো কারণ ব্যতিরেকে তাদের সদস্য পদ বাতিল দেখানো হয়েছে। এছাড়া সমিতিটি জলমহাল থেকে অনেক দুরে অবস্থিত। শালঘরিয়া মালঞ্চ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিটিও প্রকৃত মৎস্যজীবীদের নিয়ে গঠন করা হয়নি। এই সমিতির নামে পুঠিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনারে (ভূমি) কার্যালয় থেকে ১৪২৭ হতে ১৪২৯ বাংলা সন মেয়াদে দুইটি পুকুর ইজারা নেয়া হয়েছে। দেলুয়াবাড়ি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে দুর্গাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় থেকে ১৪২৫ হতে ১৪২৭ সন মেয়াদে দুইটি পুকুর ইজারা নেয়া আছে। এছাড়া এই সমিতি সংশ্লিষ্ট জলমহাল থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। দেবীপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামেও পুঠিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় থেকে ১৪২৭ হতে ১৪২৯ সন মেয়াদে দুইটি পুকুর ইজারা নেয়া আছে। দেবীপুর ডার বিল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে পুঠিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় থেকে ১৪২৭ হতে ১৪২৯ সন মেয়াদে একটি পুকুর ও দুর্গাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় থেকে একটি পুকুর ইজারা নেয়া আছে। এমনকি দেবীপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি ও দেবীপুর ডার বিল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি একই ব্যাক্তি। তিনি হলেন দেবীপুর গ্রামের আব্দুল আজিজের পুত্র রাকিবুল ইসলাম নামের একজন। এছাড়া কাশিমপুর পাবলই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সহ অধিকাংশ সদস্যই জানেন না ওই সমিতি নাম দিয়ে জলমহাল ইজারার দরপত্র দাখিল করা হয়েছে। উপজেলা যুবলীগের এক নেতা এই সমিতির কাগজপত্র সংযুক্ত করে জলমহালটি ইজারা নেয়ার জন্য দরপত্র দাখিল করেছেন বলে জানা গেছে। আর ক্ষিদ্র লক্ষিপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে মাত্র একটি পুকুর ইজারা নেয়া আছে বলে জানা গেছে।
সরকারি জলমহাল ইজারা ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় বলা আছে, সরকারি জলমহাল ইজারা নিতে হলে কমপক্ষে ২০ জন প্রকৃত মৎস্যজীবীদের নিয়ে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি গঠন হতে হবে। মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি পাওয়া না গেলে সমাজভিত্তিক মৎস্য চাষ ব্যবস্থাপনার অনুকরণে কেবল সংশ্লিষ্ট পুকুর/জলমহালের চারপাশের নিকটবর্তী অবস্থানে বসবাসরতদের নিয়ে গঠিত ও সমবায় অধিদফতর কিংবা সমাজ সেবা অধিদফতরের স্থানীয় অফিসে নিবন্ধিত একক সমিতিকে সংশ্লিষ্ট পুকুর/জলমহাল ৩ বছরের জন্য ইজারা প্রদান করা যাবে। নীতিমালায় আরো উল্লেখ আছে একটি সমিতির নামে ৩ বছর মেয়াদে বড়জোর দুইটি পুকুর/জলমহাল ইজারা দেয়া যাবে। মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই সমিতির নামে পুকুর/জলমহাল ইজারা দেয়াও যাবেনা। পুকুর/জলমহাল ইজারার বিষয়ে নিকটবর্তী সমিতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে বলেও সরকারি জলমহাল ইজারা ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে।
এ ব্যাপারে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, যাচাই বাছাই করে এবং সরকারি জলমহাল ইজারা ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুযায়ী প্রকৃত মৎস্যজীবীদের নিয়ে গঠিত সমিতিকে জলমহালটি (বিল) ইজারা দেয়া হবে।