পথে পথে ভোগান্তি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৪৭ এএম, ১ মে,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:২৯ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
আজ চাঁদ উঠলে কাল ঈদ, নয়তো পরশু। আপনজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে গ্রামে যাচ্ছে রাজধানীবাসী। সড়ক-মহাসড়কে থেমে থেমে যানজট, নৌপথে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই ও ফেরিঘাটে যানবাহনের দীর্ঘ লাইনের কারণে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে যাত্রীরা জানান। তবে গ্রীষ্মের এই সময়ে ভ্যাপসা গরমে ঈদযাত্রার ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান তারা। রেলপথে টিকিট কাটতে যুদ্ধ ও সময়মতো ট্রেন না আসায় ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।
সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, গত শুক্রবার সকাল থেকে প্রতি বাস টার্মিনাল ছিল যাত্রীতে পরিপূর্ণ। বিভিন্ন গন্তব্যের বাস কাউন্টারে আসছে আর যাত্রী বোঝাই করে চলে যেতে দেখা গেছে। তবে কিছু কিছু বাস কাউন্টারে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেন যাত্রীরা। রাজধানীর গাবতলীর বাস টার্মিনালে ‘নয়ন’ নামের বরিশালের এক যাত্রী বলেন, ‘বাড়ি যাব হেইলগ্যা সয়াল সয়াল মিরপুর থেইক্যা গাবতলী আইছি। কিন্তু বাসে ভাড়া চায় বেশি। সূর্যমুখী পরিবহনের ঢাকা থেকে বরিশালের ভাড়া ৬০০ টাকা ভাড়া চায় ৮০০ টাকা।’ একই অবস্থা রংপুরহামী পরিবহনের। ইমরান নামের রংপুরের এক যাত্রী বলেন, ‘ঢাকা-রংপুরের স্বাভাবিক বাস ভাড়া ৭৭৬ টাকা। কিন্তু এখন নেয়া হচ্ছে ১২৫০ টাকা।’ আহাদ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি বাস তার কাছ থেকে ৫০০ টাকা বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেন তিনি। আব্বাস আলী নামের রংপুরের অন্য এক যাত্রী বলেন, ‘বাসভাড়া ৭৭৬ টাকা। আমার কাছে নিল ১ হাজার ২৫০ টাকা। তারা এর কম নেবে না। কী করব, বাড়ি তো যাওয়া লাগবে।’ তিনি জানান, গত সপ্তাহে তার স্ত্রী ও সন্তান গ্রামের বাড়িতে গেছেন। শ্যামলী বাসে সেদিন তার স্ত্রী ৭০০ টাকা ভাড়া দিয়ে রংপুরে গেছেন। গত শুক্রবার সেখানে তার কাছ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা বাড়তি নেয়া হয়েছে। গাবতলীতে বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেন কুড়িগ্রামের যাত্রী আয়নাল হোসেন। তিনি জানান, ‘রংপুরগামী শ্যামলী পরিবহন তার কাছে ১ হাজার ৩০০ টাকা চেয়েছে। কুড়িগ্রামের হক পরিবহনের গাড়ি নেই। তারপর লোকাল বাসের খোঁজ করেন, কিন্তু পাননি। ১ হাজার ৩০০ টাকা চাওয়ায় তিনি আর শ্যামলী পরিবহনের টিকেট কেনেননি।’
অতিরিক্ত ভাড়া :
অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ায় গত শুক্রবার গাবতলীতে পাঁচটি বাস কাউন্টারকে জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ‘গাবতলীর সেলফী পরিবহনকে ১ হাজার টাকা, শ্যামলী পরিবহনকে ৫০০, সাথী এন্টারপ্রাইজকে ১ হাজার, অরিন ট্রাভেলসকে ১ হাজার টাকা ও শ্যামনগর পরিবহনকে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’ মঞ্জুর শাহরিয়ার বলেন, ‘আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এখানে এসেছি। এটা মূলত বিআরটিএ’র কাজ। আমরা অ্যাডিশনাল হিসেবে এসেছি, যাতে যাত্রীর কোনো হয়রানি পোহাতে না হয়। যাত্রীদের কাছ থেকে অভিযোগ শুনে আমরা বিভিন্ন কাউন্টারে গেছি।’ তবে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবাদুল কাদের বললেন, ‘দু-একটা ঘটনা হয়তো ঘটছে।’ শুক্রবার সকালে গাবতলী বাস টার্মিনালে সড়ক মন্ত্রীর পরিদর্শনকালে বাসে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দু-একটা ঘটনা হয়তো ঘটছে। আমাদের লোক সার্বক্ষণিক দায়িত্বে আছে। এ রকম কিছু হলে আমরা অবশ্যই দেখব।’
ফেরিঘাটে যানবাহনে দীর্ঘ লাইন, যাত্রীদের ভোগান্তি :
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার ঘরমুখো মানুষ ও যানবাহনের চাপে ভোগান্তি সৃষ্টি হয়ে মাওয়া-শিমুলিয়া ও দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটে। গত শুক্রবার সকাল থেকেই দুই ফেরিঘাটে বাস, ছোট যানবাহন, প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল দেখা গেছে। এর সঙ্গে পণ্যবাহী ট্রাক ও অ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন যানবাহনের দীর্ঘ লাইন সৃষ্টি হয়েছে। যানবাহনের চাপ ও গরমের মধ্যে ফেরির অপেক্ষায় থাকায় ঘাটে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। এছাড়া যাত্রী ও যানবাহনের চাপ বেশি থাকায় লঞ্চ ও স্পিডবোটে অতিরিক্ত যাত্রী ও বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেন যাত্রীরা। হাসিব নামের শরীয়তপুরের এক যাত্রী বলেন, ‘আগে স্পিডবোটে ১২০ টাকা ১৫০ টাকা নিত। কিন্তু ঈদ উপলক্ষে এখন ১৮০-২০০ টাকা ভাড়া নিচ্ছে জনপ্রতি। অথচ নির্ধারিত ভাড়া হলো ১৫০ টাকা। এটা কেউ মানছে না।’ মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে কর্তৃপক্ষের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে ঘাটে দীর্ঘ গাড়ির লাইন ঘরমুখো যাত্রীদের চরমে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান। সংবাদের মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে কর্তৃপক্ষের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে ঘাটে দীর্ঘ গাড়ির লাইন। আটকা পড়েছে পাঁচ শতাধিক গাড়ি। ঘাটে ফেরি থাকলেও আনলোড করা যাচ্ছে না। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে ঘরমুখো মানুষ ও যানবাহনের চাপ ও দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। সরকারি ছুটি শুরু হওয়ায় বৃহস্পতিবার রাত থেকে শিমুলিয়া ঘাটে যানবাহন ও যাত্রীদের চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ। সরেজমিন দেখা যায়, ফেরি কম থাকায় বিপুলসংখ্যক যানবাহন পারপারে বেশি সময় লাগছে। এতে ঘাটে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে যাত্রীদের। ঘাটের পার্কিং ইয়ার্ড থেকে পন্টুনের অভিমুখ পর্যন্ত যানবাহন সারি। স্পিডবোট ও লঞ্চঘাটে যাত্রীদের চাপ শুক্রবারের তুলনায় চার গুণ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভিআইপি কর্মকর্তা বলেন, নিজস্ব প্রাইভেটকারের করে শ^শুরবাড়ি যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অবস্থাপনায় হতাশ তিনি। এলোমেলো করে গাড়ি পার্কিং করে রাখা এবং গাড়ি থেকে টাকা উত্তোলন করে গোপনে সিরিয়াল ব্রেক করে গাড়ি ফেরিতে উঠানোর প্রত্যক্ষদর্শী বলে অভিযোগ করেন তিনি। ঘাটের গাড়ি নিয়ে আসা আরও অনেক ভিআইপি লোকজনই অভিযোগ করে বলেন, যাত্রীবাহী গাড়ি ঘাটে এলেই মাঠের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দেয় ঘাট কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে বুঝে বুঝে টাকা-পয়সা নিয়ে গাড়ির সিরিয়াল ফেরিতে দেয়া হয়। অন্যদিকে ঘাটে পুরো রাস্তাজুড়েই যখন মোটরসাইকেল ফেরিতে উঠে তখন আর যাত্রীবাহী প্রাইভেট কার বা বাস উঠতে পারে না। পুলিশ প্রশাসন সকাল থেকে কাজ করলেও তাদের ওভারকাম করে বিআইডব্লিউটিসি ঈদে যাত্রীবাহী প্রাইভেটকার ও বাস থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে সিরিয়াল দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। ফলে এসব অব্যস্থাপনার কারণেই যাত্রীরা গরমে এবং রোজার চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বিআইডাব্লিউটিএ’র শিমুলিয়া নদীবন্দরের নৌনিরাপত্তা বিভাগের সহকারী পরিচালক শাহাদাত হোসেন জানান, এ রুটে আরও পাঁচটি লঞ্চ ও তিনটি স্পিডবোট বেড়েছে। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও মাজিকান্দি দুই রুটে ৮৫টি লঞ্চ ও ১৫৫ স্পিডবোট সচল রয়েছে। বিআইডাব্লিউটিসি’র পরিচালক (বাণিজ্য) আশিকুজ্জামান জানান, গত বৃহস্পতিবার পাঁচ হাজার গাড়ি পারাপার করেছি। ১০টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। আমরা তো একসঙ্গে সবাইকে পার করতে পারব না। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটেও একই অবস্থা। গত শুক্রবার সকাল থেকেই যাত্রী ও যানবাহনের চাপে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাটে ছিল যানবাহনের দীর্ঘ লাইন। পাটুরিয়া ঘাটে ৩২টি লঞ্চ ও ২১টি ফেরি দিয়ে যাত্রী ও যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। তবে যানবাহনের চাপ বেশি থাকায় ফেরিঘাটে আসার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। রাজবাড়ীগামী একটি লঞ্চের যাত্রী কামাল হোসেন বলেন, ‘লোকাল বাসে আসছি, অনেক দূরে নামায় দিছে, সেখান থেকে হেঁটে আসছি। ফেরিতে পার হতে হলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, সময় বেশিও লাগে। তাই লঞ্চে পার হব।’ এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসি’র দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক মো. শিহাব উদ্দীন জানান, ‘ঈদে যাত্রী ও যানবাহন পারাপারে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ১১টি রো রো ফেরি, ৭টি ইউটিলিটি ফেরি, ২টি ড্রাম ফেরি, ১টি ছোট ফেরিসহ মোট ২১টি ফেরি চলাচল করছে। পাশাপাশি যাত্রী পারাপারে ২১টি লঞ্চ চলছে।’
ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কে যানবাহনের ধীরগতি :
গত শুক্রবার রাজধানীর প্রবেশপথ আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত যানবাহনের ধীর গতি লক্ষ করা গেছে। এ মহাসড়কে বিআরটি প্রজেক্টের কাজ চলমান থাকা ও নির্মাণসামগ্রী মহাসড়কের ওপর রাখায় কোথাও কোথাও মহাসড়ক সরু হয়ে গেছে। এতে যান চলাচল কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান। কাওসার হোসেন নামের ময়মনসিংহের এক যাত্রী বলেন, ‘যানজট ও দুর্ভোগের শঙ্কা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছি। কিন্তু মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটে পড়তে হয়নি। তবে বিআরটিএ’র নির্মাণকাজের কারণে সড়কের অনেক স্থানে ছোট হয়েছে।’ এছাড়া বিভিন্নস্থানে দূরপাল্লার বাস, খোলা ট্রাক, পিকআপ, লোকাল বাস, মিনিবাসে যাত্রী উঠানামার কারণে যানবাহনের ধীরগতি সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মহাসড়কে যানজটের ভোগান্তি :
সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম মহাসড়কে রাস্তায় একটি ট্রাক বিকল হয়ে পড়ায় ঢাকা-সিরাজগঞ্জ মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। গত শুক্রবার দুপুরের দিকে মহাসড়কের কামারখন্দ উপজেলার বালুকুল এলাকায় ট্রাক বিকল হয়ে এ যানজটের শুরু হয়। পরে তা মহাসড়কের কড্ডার মোড়, মুলিবাড়ী, বঙ্গবন্ধু সেতু গোলচত্বর এবং পশ্চিমে নলকা মোড় পর্যন্ত অন্তত ১৫ কিলোমিটার এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। এই যানজটের কারণে পুরো মহাসড়কে যানবাহনের ধীরগতি সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।