চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে প্রকৌশলীই ঠিকাদার, তিনিই সব
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৩১ এএম, ১৪ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০১:১৩ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
সব সম্ভবের প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। যেখানে যিনি ঠিকাদার, তিনিই প্রকল্পের প্রাক্কলনকারী। আবার তিনিই কাজের তদারককারী এবং বিল তৈরিকারী। চেকের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন থেকে কাজের বিলও তুলেছেন। ব্যাংক হিসাবটি এখনো সচল আছে। ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটিও হয়েছে। কিন্তু তদন্ত কমিটি রহস্যজনক কারণে ঘটনার সত্যতা পায়নি। তবে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে অনিয়মের চিত্র।
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯-এর ধারা ৯২-এর তফসিল ৬-এর ৫৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, কর্পোরেশনের কোনো কাউন্সিলর বা কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক সজ্ঞানে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, স্বয়ং বা কোনো অংশীদার মারফত কর্পোরেশনের কোনো ঠিকাদারিতে স্বত্ব বা অংশ অর্জন করা বেআইনি।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সরওয়ার আলম খান। তিনি সিটি কর্পোরেশনে অস্থায়ী ভিত্তিতে যোগদান করেন সাবেক মেয়র এম মনজুর আলমের আমলে। ২০১৪ সালে তিনি এবং তার ব্যবসায়িক বন্ধু মো. যায়েদ হাসান চৌধুরীর নামে সিটি কর্পোরেশন থেকে একটি ট্রেড লাইসেন্স নেন। যার নম্বর ১৭১৩৫৮। কিন্তু ট্রেড লাইসেন্সে যে ঠিকানা ব্যবহার করেন সেখানে অলটেক কর্পোরেশনের কোনো অফিসও নেই।
একই সময় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক চকবাজার শাখায় একটি যৌথ একাউন্ট খুলেন। যার হিসাব নম্বর ৩০০৮১১১০০০০৬১১৩। প্রতিষ্ঠানের নাম দেন মেসার্স অলটেক কর্পোরেশন। এই প্রতিষ্ঠানের নামে তিনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ঠিকাদারি কাজ নেন। তিনি নিজেও ওই বিভাগে চাকরি করেন। তিনি যেসব কাজ পান তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল যেমন মাতৃসদন হাসপাতালের পুরাতন ও নষ্ট এয়ার কন্ডিশনার মেরামত ও সার্ভিসিং করে আন্দরকিল্লাস্থ নগর ভবনে নির্বাহী প্রকৌশলীদের কক্ষে স্থাপন। যার ফাইল নম্বর ১৫২/১৬। যার কাজের মূল্য তিন লাখ ৭০ হাজার টাকা। ট্রাফিক সিগন্যালের অচল মোড়সমূহের পুল উত্তোলন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ। যার ফাইল নম্বর ৯২/১৬। যেমন মাতৃসদন হাসপাতালের নষ্ট ও পুরনো এয়ারকন্ডিশনসহ আনুষঙ্গিক মালামাল খোলার কাজ। যার ফাইল নম্বর ৪/১৬। কাজের মূল্য এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৭৫ টাকা। ৭৬ (ট) ধারায় অর্থাৎ বিনা টেন্ডারে তিনি এসব কাজ করেন। এছাড়া তিনি আরো বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ বিনা টেন্ডারে করেছেন বলে অভিযোগ আছে। কাজের প্রাক্কলন, তদারক, বিল তৈরি এবং ঠিকাদারি সবই তিনি করেছেন।
২০১৭ সালে ২৪ আগস্ট এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ পড়লে ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম স্থানীয় সরকার বিভাগের সহকারী কমিশনার (মূল্যায়ন) উজালা রাণী চাকমা অভিযোগ তদন্তে শুনানির জন্য সরওয়ার আলম খানকে চিঠি দেন। অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত উভয়ের পক্ষ থেকে বক্তব্য নেন। উজালা রাণী চাকমার তদন্তে সরওয়ার আলম খানের ঠিকাদারি ব্যবসার তথ্য উঠে আসেনি। তিনি অভিযোগ থেকে খালাস পান।
অভিযোগ আছে, তদন্তকারী কর্মকর্তাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অভিযোগ হতে পার পেয়ে যান সরওয়ার আলম খান। অথচ ২০১৫ সালে মেয়র মনজুর আলম স্বাক্ষরিত সোনালী ব্যাংক সিরাজদৌল্লাহ শাখার দুটি চেক মেসার্স অলটেক কর্পোরেশনের নামে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে তাদের যৌথ হিসাবে জমা হয়। ২০১৫ সালের ২৪ মার্চে চসিকের দেয়া ৩৬ হাজার ৫৭৬ টাকার চেক ওই হিসাবে জমা হয়। যার নম্বর ৪৫৯১২৬৪। এই চেক ক্লিয়ারিং হয় ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল। ২০১৫ সালের ৩০ জুনে প্রদানকৃত ৯৬ হাজার টাকার চেক নম্বর ৪৫৯১৭০৫। এটি ক্লিয়ারিং হয় একই বছরের ১২ জুলাই। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা রহস্যজনক কারণে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব কিংবা যাচাই করে দেখেননি। এরই মধ্যে ব্যাংকে যৌথ স্বাক্ষরের পরিবর্তন করে শুধু যায়েদ হাসান চৌধুরীকে স্বাক্ষর ক্ষমতা দেয়া হয়।
সম্প্রতি সরওয়ার আলম খানের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পাঁচ প্রকৌশলী ও কর্মচারী তিনটি অভিযোগ করেন। তার মধ্যে একটি ছিল মেসার্স অলটেক কর্পোরেশনের মাধ্যমে চসিকে ঠিকাদারি ব্যবসা। চসিকের সচিব আবু শাহেদ চৌধুরী অভিযোগের তদন্ত করেন। তিনিও মেসার্স অলটেক কর্পোরেশনের ব্যাংকিং লেনদেন এবং হিসাব খোলার সময় কারা এর সিগনেটরি অথরিটি ছিলেন, কখন পরিবর্তন হয়েছে তার কোনো তথ্য সংগ্রহ না করেই প্রতিবেদন দিয়ে দেন।
অপরদিকে, চসিকের রাজস্ব বিভাগের পাঁচ নম্বর সার্কেলের (লাইসেন্স) বালামে ২০১৭ সালে ট্রেড লাইলেন্সের মালিকানায় সরওয়ার আলম খানের নামটি বাদ দিয়ে শুধু মো. যায়েদ হাসান চৌধুরীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর আগে ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারি মো. যায়েদ হাসান চৌধুরী চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা বরাবরে ট্রেড লাইসেন্সটি বাতিলের আবেদন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেটি বাতিল না করে একক নামে রেখে দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই সময় লাইসেন্সটির আসল কপি হারিয়ে যাওয়ার অজুহাতে ফটোকপিতে কাটাছেঁড়া করে চসিকের বালাম খাতায় শুধু যায়েদ হাসান চৌধুরীর নাম তোলা হয়। এই ফটোকপির মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তাদেরও বিভ্রান্ত করা হয়। এ কাজে তাকে রাজস্ব বিভাগের লাইসেন্স শাখার কতিপয় কর্মকর্তা সহযোগিতা করেছেন।
এই লাইসেন্সের বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে কোন তথ্য না দিলেও তারা দ্রুত বিষয়টি সরওয়ার আলম খানকে জানিয়ে দেন। তবে উপ-সহকারী প্রকৌশলী সরওয়ার আলম খান বলেছেন, তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ মিথ্যা। সিটি কর্পোরেশনের সাথে তিনি কোনো ব্যবসা করেননি। চসিকের রাজস্ব বিভাগের সার্কেল ৫-এর কর কর্মকর্তা (লাইসেন্স) মোহাম্মদ ইউসুফ কথা বলতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চসিকের সচিব আবু শাহেদ চৌধুরী বলেন, লাইসেন্স শাখা থেকে যে তথ্য দিয়েছে তাই তিনি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন। ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেসব তথ্যের কথা তিনি এই মুহূর্তে জানতে পেরেছেন তা যাচাই করা হবে। প্রয়োজনে ব্যাংকে চিঠি লেখবেন বলে জানান।