কুমিল্লা দক্ষিনাঞ্চলে ভেজাল ঔষধের রমরমা ব্যবসা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:৪৩ পিএম, ৩ জানুয়ারী,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৫৭ পিএম, ১২ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
কুমিল্লা দক্ষিনাঞ্চলের লাকসাম, লালমাই, বরুড়া, নাঙ্গলকোট, সদরদক্ষিণ ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা জুড়ে হরেক রকম সিন্ডিকেট আর ভেজাল ঔষধে ভরে গেছে গ্রামীন হাট-বাজার এবং স্বাস্থ্যসনদ বিহীন রমরমা ঔষধের ব্যবসায় প্রতারনার শিকার এ অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ। শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জের ফার্মেসীগুলোতে ভেজাল, মেয়াদউর্ত্তীণ, নিম্নমান ও জেলার সীমান্ত পথে চোরাই ভাবে আসা ভারতীয় নিষিদ্ধ হরেক রকম ঔষধে সয়লাব হয়ে গেছে। ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে সাধারন মানুষ। এ অঞ্চলের সর্বত্র হাট-বাজার গুলোতে প্রকাশ্যে ড্রাগ লাইসেন্স বিহীন ঔষধের ব্যবসা ও চোরা পথে আসা বে-আইনী মাদকদ্রব্য এবং ক্ষতিকর নিম্নমানের বিভিন্ন ঔষধ সামগ্রী আমদানী এখন ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। অথচ এলাকার স্বাস্থ্য দপ্তর কর্তৃপক্ষ নিরব দর্শক।
জানা যায়, জেলা দক্ষিনাঞ্চলের ৬টি উপজেলার হাট-বাজারগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মত প্রাইভেট ক্লিনিক ও যত্রতত্র ঔষধের দোকান গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে ৯০ ভাগ ঔষধের দোকানের কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। এছাড়া বিভিন্ন দোকানে সরকার নিষিদ্ধ নিম্নমান ও মেয়াদউর্ত্তীন এবং নানাহ এলকোহলযুক্ত ড্রাগস-মাদকদ্রব্যসহ বিদেশী ঔষধপত্র প্রকাশ্যে বিক্রি করছে এতে কোন বিধি নিষেধ নেই বললেই চলে। এ অঞ্চলে বেশ ক’টি প্রাইভেট ক্লিনিক গড়ে উঠলেও তা আজ কসাইখানায় পরিনত। সরকারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো বর্তমানে নিজেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। বিশেষ করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ডাক্তার নেই। ঔষধ সংকট, আধুনিক বা প্রযুক্তিগত চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই।
স্থাণীয় লোকজন জানায়, এ অঞ্চলে এক শ্রেনীর অসাধু ঔষধ পাইকারী বিক্রেতারা বেশী লাভে ভেজাল ও নিম্নমানের ঔষধ গ্রাম-গঞ্জের ফার্মেসী ও হাতুড়ে পল্লী চিকিৎসকের মাধ্যমে বাজারজাত করে চলেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে ঔষধের দাম নিয়ে নানাহ কমিশন বানিজ্যে চলছে সীমাহীন নৈরাজ্য। এতে প্রতারনার শিকার হচ্ছেন ভোক্তারা। ওইসব দোকানীরা জীবনরক্ষাকারী ঔষধের মূল্য প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করার সুযোগে নকল, ভেজাল ও নিষিদ্ধ ঔষধে বাজার সয়লাব হয়ে পড়ায় ওইসব ঔষধ ব্যবহার করে মানুষ পড়ছেন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। এ অঞ্চলে পল্লী চিকিৎসক সমিতি, ড্রাগিষ্ট এন্ড ক্যামিষ্ট সমিতি, ঔষধ দোকান মালিক সমিতিসহ রয়েছে হরেক রকম সাইনবোর্ড সর্বস্ব ঔষধ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থা। তারপরও এ অঞ্চলে হাতেগোনা কয়েকজন ফার্মাসিষ্ট, পল্লী চিকিৎসক, ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসক ছাড়া বেশির ভাগই ঔষধ প্রশাসনের নিবন্ধনবিহীন শত শত ঔষধের দোকানে চলছে রমরমা ভেজাল ঔষধের বানিজ্যের নামে নৈরাজ্য। বিশেষ করে ওইসব সমিতির নামে কয়েকদিনের চিকিৎসা প্রশিক্ষন নিয়ে রাতারাতি অনেকেই গ্রাম্য ডাক্তার সেজে বসে গেছেন এ পেশায়। মূলত ওইসব চিকিৎসাবিদদের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কিংবা স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয়ের কোন অনুমোদন নেই। এছাড়া পল্লী চিকিৎসক সমিতিসহ অপরাপর সমিতির কর্মকান্ড নিয়ে এলাকার জনমনে রয়েছে হরেক রকম বিতর্ক।
জেলার বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়, এ অঞ্চলে একই ঔষধ ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানী থেকে বিভিন্ন নামে বাজারে আসছে তেমনি এসব ঔষধের গুনাগুনেও ভিন্নতা রয়েছে। সকল ঔষধই একই মানের নয় আবার শহর এলাকায় যেসব ঔষধ পাওয়া যায় গ্রামাঞ্চলে সেগুলো পাওয়া যায় না। দেশে প্রচলিত প্রায় ২৩ হাজার ঔষধের মধ্যে ১১৭টি নমুনার গুনাগুন, মান নির্নয় ও মূল্য নির্ধারনে সরকারের হস্তক্ষেপ রয়েছে। কিন্তু বাকী সবগুলো ঔষধের নিয়ন্ত্রন করছেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে বাজারে বিক্রিকালে কোন কোন সময় ঔষধের দাম হঠাৎ করে বাড়িয়ে দেন ওইসব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি বিদেশ থেকে হরেক রকম ঔষধ কিংবা ফুড সাপ্লিমেন্ট নামে আমদানী করা পন্য নিয়ে রয়েছে হাজারো বির্তক। এ অঞ্চলের স্থানীয় প্রশাসন মাঝে মধ্যে বাজার মনিটরিং এবং ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করলেও টনক নড়ছে না স্বাস্থ্যদপ্তর কিংবা ঔষধ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
সূত্রগুলো আরও জানায়, দেশের বিভিন্ন ল্যাবরোটরীতে দেশীয় উৎপাদিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এনার্জী ড্রিঙ্কস এর নমুনা পরীক্ষায় বের হয়ে আসে লোমহর্ষক চিত্র। বেশির ভাগ এনার্জী ড্রিঙ্কস এ রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত সোডিয়াম বেনজোয়েট, ইথানল, ক্যাফেইন ও বিষাক্ত সেগারিনসহ হরেক রকম রাসায়নিক দ্রব্য। অথচ সেগুলো পান করে মানুষের কিডনী, মস্তিস্ক ও মৃগীরোগের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে অস্তঃস্বত্তা মা- সন্তানসহ নানাহ জটিলরোগে আক্রান্তের ঝুঁকি বেড়ে যায় সকল মানুষের। এ অঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করনে জেলা ড্রাগ সুপার ও সিভিল সার্জনের দায়িত্ব অতি মূখ্য হলে রহস্যজনক কারনে তারা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। অথচ ওইসব নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধি। স্থাণীয় চিকিৎসক, পল্লী চিকিৎসক ও বিভিন্ন ঔষধ দোকানদারদের সাথে স্থানীয় সরকারি-বেসরকারী প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর কমিশন বানিজ্য জমে উঠেছে। এছাড়া বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধি গুলোর সাথে চিকিসৎকদের গিভ এন্ড টেক পদ্ধতিতে ওইসব ভেজাল ও নিম্নমানের ঔষধ বাজারজাত করনে হাতুড়ে ডাক্তার ও ঔষধের দোকান মালিকদের সাথে মোটা অংকের ব্যবসায়ী কমিশন কাজ করছে বলে এলাকার জনমনে অভিযোগ।
এ অঞ্চলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ ক’জন চিকিৎসক জানায়, ঔষধ এমন একটি পন্য যা সরাসরি মানুষের জীবন-মরনের সাথে জড়িত। স্থানীয় দোকানীরা অধিক মুনাফার লোভে জীবন রক্ষাকারী ভেজাল ও নিম্নমানের হরেক রকম ঔষধ বেচাকেনা করছে। এছাড়া জেলার ভারত সীমান্ত দিয়ে চোরাপথে আসা বিভিন্ন ঔষধগুলো নিয়ে রয়েছে প্রচুর অভিযোগ।
এ ব্যাপারে জেলা-উপজেলা স্বাস্থ্য দপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মুঠোফোনে বার বার চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।