পরিবহন বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে কর্মমুখী মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:১৪ এএম, ৭ নভেম্বর,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:৫২ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর,
বুধবার,২০২৪
কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই দেশে হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবাদে শুক্রবার সকাল থেকে সারা দেশে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট চলছে। দ্বিতীয় দিনের মতো আজও পরিবহন বন্ধ রেখেছে মালিকরা। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন কর্মমুখী মানুষ।
আজ শনিবার সকালে ঢাকা-আরিচা, চন্দ্রা-নবীনগর ও টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়ক ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছেন অফিসগামীরা। পরিবহনের দেখা না পেয়ে অনেকেই হেঁটে রওনা দিয়েছেন কর্মস্থলের উদ্দেশে। কেউবা ছুটছেন ভ্যান, রিকশা কিংবা ইজিবাইকে। যেভাবেই হোক সকাল ৮টার আগেই পৌঁছাতে হবে কর্মস্থলে।
পোশাকশ্রমিক আহমেদ বলেন, কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। পরিকল্পনা করে দাম বাড়ানো হলে আমরা আর ভোগান্তিতে পড়তাম না। শুধু ভোগান্তিই নয়, ঠিক সময়ে অফিস পৌঁছাতে না পারলে হাজিরা বোনাস প্রায় ৫০০ টাকা কাটা যাবে। তার ওপর রিকশাভাড়া দ্বিগুণ দিয়ে অফিসে পৌঁছাতে হচ্ছে। একদিকে ভোগান্তি, অন্যদিকে হাজিরা বোনাস কাটাসহ অফিসের লোকদের মন্দ কথা শুনতে হবে। আর পরিকল্পনা করে তেলের দাম বাড়ালে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। কর্মস্থলে হেঁটেই রওনা দিয়েছেন পোশাকশ্রমিক বিউটি বেগম।
তিনি বলেন, আমার স্বামী চাকরি করেন জিরানী বাজার। সেখানেই আমি স্বামীর সঙ্গে থাকি। প্রতিদিন সকালে উঠে বাসার কাজ শেষে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে অফিসের উদ্দেশে রওনা হই। আজও তাই করেছি। কিন্তু রাস্তায় বের হয়ে দেখি গাড়ি নেই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম কিন্তু গাড়ি আসল না। পরে জানতে পারলাম ধর্মঘট চলছে। আমি ধর্মঘটের খবর শুনিনি। শুনলে হাতে একটু সময় নিয়ে বের হতাম।
এদিকে পরিবহন ধর্মঘটের কারণে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন রিকশা-ভ্যানচালকরা। ১০ টাকার ভাড়া তারা হাঁকছেন ২০ টাকা।
রিকশাচালক হান্নান বলেন, যাত্রীর খুবই চাপ। সড়কে গাড়িও নেই, সবাই ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই আমিও বেশি ভাড়া নিচ্ছি। এতে দোষের কিছু নেই। আমরা ভাড়া মিট করেই গন্তব্যে রওনা করি। যাদের ইচ্ছে তারা যাবে, যাদের ভালো লাগবে না তারা হেঁটে যাবে। এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটির আশুলিয়া অঞ্চলের সভাপতি লায়ন মোহাম্মদ ইমাম বলেন, আসলে তেলের দাম বাড়ানোর আগে এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কতিপয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। হঠাৎ করে তেলের দাম বাড়ানোয় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আশা করি সাধারণ জনগণের বিষয় মাথায় রেখে উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধান হবে।
পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা বাস মালিক দেলোয়ার হোসেন দিলু বলেন, আমরা আসলে সমাধান চাই। তেলের দাম বাড়লে ভাড়াও বাড়াতে হবে। আর সেটা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। তা নাহলে তেলের দাম কমাতে হবে। দাবি মেনে না নিলে পরিবহন ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।
উল্লেখ্য, গত বুধবার (৩ নভেম্বর) মধ্যরাত থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়। জ্বালানি তেলের দাম ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে বাড়ানো হয় কেরোসিনের দাম। ডিজেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা ও তা কার্যকরের পর থেকেই পরিবহন খাতে এর প্রভাব পড়তে থাকে। এরপরই শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে পরিবহন মালিকরা তেলের দাম কমানো বা ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট শুরু করেন।
প্রাইভেটকার-মোটরসাইকেল-রিকশার দখলে রাজধানীর সড়ক : কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে যাবেন আশরাফুল ইসলাম। ছোট ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। তাই তার বাড়ি যাওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় গতকাল শনিবার সকালে মোটরসাইকেলে করে রাজধানী ছাড়েন তিনি। মহাখালী এলাকায় ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় তার।
তিনি বলেন, পরিবহন ধর্মঘট চলছে এ কারণে বিপদে পড়েছি। বাড়ি যাওয়াটাও জরুরি হয়ে পড়েছে। উপায় না পেয়ে মোটরসাইকেলে করে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছি। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করায় ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে শুক্রবার (৫ নভেম্বর) সকাল ৬টা থেকে সারাদেশে সড়কে বাস ও ট্রাকসহ পণ্যপরিবহন বন্ধ রেখেছেন মালিকরা। শনিবারও তারা রাজধানীসহ সারাদেশে গণ ও পণ্যপরিবহন বন্ধ রেখেছে। এতে যাত্রীরা চরম বিপাকে পড়েছেন। শনিবার সকাল থেকে রাজধানীতে বাস ও মিনিবাস চলাচল করতে দেখা যায়নি। তবে সড়কে বিআরটিসির বাস, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল ও রিকশায় যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। এছাড়া প্রাইভেটকারেও যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। সকাল ৯টায় মহাখালী লেভেল ক্রসিংয়ে বিআরটিসির দোতলা বাসে যাত্রীর অতিরিক্ত চাপ দেখা। থেমে থেমে চলতে থাকা বাসে তবুও যাত্রী উঠছিলেন। অনেককে বিআরটিসি বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে যাতায়াত করতে দেখা গেছে। ভিড় বাসে ওঠা যাত্রী সফর আলী বলেন, দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে বাস পেয়েছি। আমি টঙ্গী যাব। টঙ্গী যেতে তিনি বহু অপেক্ষার পর বাস পেলেও মহাখালীতে রাস্তায় শত শত যাত্রী অপেক্ষায় ছিলেন গণপরিবহনের জন্য। ওই এলাকা থেকে প্রাইভেটকারে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা যায়।
কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুক্রবার ধর্মঘট শুরু হওয়ার পর থেকে প্রাইভেটকারে যাত্রী পরিবহন করছেন অনেক চালক। মোটরসাইকেলে করে উত্তরা ও টঙ্গীর দিকে যেতে দেখা যায় অনেক যাত্রীকে। যানজটে থেমে থাকা একটি মোটরসাইকেলের যাত্রী শরীফ উদ্দিন বলেন, ২০০ টাকার ভাড়া ৫০০ টাকা হয়ে গেছে। তবু যেতে হবে। জরুরি কাজ পড়েছে। গতকাল শনিবার ছুটির দিন হলেও বনানী, মহাখালী, বিজয় সরণী, আগারগাঁও ও মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বর সড়কে প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল ও রিকশার জট দেখা গেছে।
পরিবহন ধর্মঘটে কক্সবাজারে ২০ হাজার পর্যটক আটকা, যেতে পারেনি ৩০ হাজার : হঠাৎ করে গণপরিবহন ও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ হওয়ায় পর্যটন শহর কক্সবাজারে প্রায় ২০ হাজার পর্যটক আটকা পড়েছেন। তারা বৃহস্পতি ও শুক্রবার ভোরে কক্সবাজারে এসেছিলেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় নিজ গন্তব্যে ফিরতে পারেননি। এদিকে অনেক পর্যটক অতিরিক্ত ভাড়ায় উড়োজাহাজে কক্সবাজার ত্যাগ করেছেন। যাদের সেই সামর্থ্য নেই তারা ছোট যানবাহনে কক্সবাজার ছাড়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু অন্য সময়ের চেয়ে ভাড়া দুই-তিন গুণ হওয়ায় তারা কক্সবাজার ত্যাগ করতে পারছেন না।
জানা গেছে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে বৃহস্পতি-শুক্র ও শনিবার হাতে রেখে কক্সবাজার আসেন লাখো পর্যটক। অনেকেই কক্সবাজার এসেছেন বৃহস্পতিবার। আবার শুক্রবার ভোরেও পৌঁছান অনেকে। যারা শুক্রবার ফিরে যাওয়ার সিডিউলে এসেছিলেন তারা এসেছিলেন আরও কয়েক দিন আগে। এ রকম প্রায় ২০ হাজার পর্যটক আটকা পড়েছেন বলে জানিয়েছেন হোটেল সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সেক্রেটারি আবুল কাশেম সিকদার জানান, আগে থেকে হোটেল রুম বুকিং দিয়ে যাদের শুক্রবার বিকেলে পৌঁছার কথা ছিল, যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় এরকম প্রায় ৩০ হাজার পর্যটক আসতে পারেনি। হঠাৎ দূরপাল্লার বাস বন্ধ হওয়াতে পর্যটকরা চরম বেকাদায় পড়েছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও।
জানা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে শুক্রবার সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য গণপরিবহন, মালবাহী ট্রাক ও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয় পরিবহন সংগঠনের নেতারা। যার প্রভাব পড়েছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন শাখার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মুরাদ ইসলাম বলেন, পর্যটক আটকা পড়ার বিষয়টি খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তারা সহযোগিতা চাইলে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
১৫০ টাকার ভাড়া ১৩শ টাকা : ডিজেলের দাম বাড়ানোয় সারাদেশের মতো বরগুনাতেও চলছে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট। আন্তঃজেলা বাস চলাচল বন্ধ থাকায় মোটরসাইকেলে দশগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে যাত্রীদের। বরগুনা সদরের টাউনহল বাসস্ট্যান্ড ঘুরে দেখা যায়, বিভাগীয় শহর বরিশালে যাওয়ার জন্য সকাল থেকে যাত্রীরা ভিড় করছে টাউনহল মোটরসাইকেল স্ট্যান্ডে। যেখানে ১৫০ টাকায় বাসে সরাসরি বরিশাল যাওয়া যেত সেখানে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল রিজার্ভ করে বরিশাল যেতে লাগছে ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের।
শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম রাকিব বলেন, আমি বরিশাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আমার সেমিস্টার ফাইনাল সামনে। তাই ফরম ফিলাপ ও সেমিস্টার ফি জমা দিতে হবে। ফি জমা দেয়ার সময় শেষ হবে কালকে। তাই অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে মোটরসাইকেলে বরিশাল যাচ্ছি। বাস চলাচল করলে এত টাকা খরচ হতো না। বরগুনা রানা মটরসের প্রোপাইটর মোহাম্মদ রানা জানান, আমরা মোটরসাইকেল সার্ভিসিং করি। একটি মোটরসাইকেলের জন্য আর্জেন্ট কয়েকটা পার্টস দরকার যা বরিশাল ছাড়া এদিকে নেই। তাই বাধ্য হয়ে ১৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে বরিশাল যেতে হচ্ছে মালামাল আনতে। এরকম চলা সম্ভব না।
রাজু আহম্মেদ নামে এক চাকরিজীবী বলেন, আমার কিছুদিন আগে পরিসংখ্যানের একটি প্রকল্পে চাকরি হয়। আজকে আমার ট্রেনিং ছিল। সকাল ৮টায় বরগুনা থেকে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে করে বরিশাল গিয়েছি। ১ ঘণ্টার পরীক্ষা শেষে আবার ওই মোটরসাইকেলেই ফিরেছি। মোট ২০০০ টাকা দিতে হয়েছে চালককে। যেখানে আমি ৩০০ টাকায় বরিশাল যাওয়া আসা করতে পারতাম সেখানে ২০০০ হাজার টাকা খরচ। প্রসঙ্গত, গত ৪ নভেম্বর জ্বালানি তেলের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধি করেছে সরকার। এ কারণে ৫ নভেম্বর থেকে সারাদিন সকল ধরনের বাস, ট্রাক চলাচল বন্ধ রেখেছে মালিকরা।