১৫ বছর শেকল বন্দি রবিউল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:১১ পিএম, ৩১ জুলাই,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:৩০ পিএম, ১৮ নভেম্বর,সোমবার,২০২৪
হাসিখুশি ও করিতকর্মা রবিউলের জীবন ১৫ বছর ধরে শেকল বন্দি। সামান্য জ্বর থেকে শরীরে নানা উপসর্গ, আর এখন সম্পূর্ণ মানসিক ভারসাম্যহীন এই তরুণকে নিয়ে দিশেহারা তাঁর নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। মায়ের কান্না, বাবার ভাবনা কোন কিছুই আর ছোঁয় না এই তরুণের হৃদয়-মনকে। তাঁর পরিবারের অসহায়ত্ব আর রাষ্ট্রের সঠিক নজরদারির অভাবে এখানে বিপন্ন হয়ে পড়েছে মানবতা।
ফরিদপুরে বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের পশ্চিম চরবর্ণি গ্রামের বাসিন্দা এই তরুণের পুরো নাম মো. রবিউল মোল্লা (৩৫)। তিনি ওই গ্রামের ভ্যানচালক মো. নুরুল মোল্লার তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড়।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে ওই তরুণের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেলো মনভাঙা এক দৃশ্য।
বাড়ির পরিত্যক্ত চৌচালা একটি টিনের ঘরে মাজায় তালাসহ শেকল লাগানো রবিউলকে পাওয়া গেলো প্রায় ছয় ফুট গভীর মাটির গর্তে। পরিবারের সদস্যদের কথা বলে জানা গেল, গত ১৫ বছরের শেকল বন্দি জীবনে ঘরটির মাটির মেঝে হাত দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে রবিউল নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন নিজের এই পৃথিবী, অর্থ্যাৎ চারিদিকে প্রায় ১১ ফুট ব্যাসের ও ৬ ফুট গভীর গোলাকার মাটির এই বাংকারটি।
বাংকার কি জিনিস এটা না বুঝলেও রবিউলের হাতের নখ ও আঙুল ব্যবহার করে তৈরি বড়সড় গর্তটি একটি বাংকারেই রূপ নিয়েছে। পরিবারের বসবাসে পরিত্যক্ত এই টিনের ঘরটি প্রায় ২৬ হাত লম্বা ও ৮ হাত চওড়া।
মা আসমানী বেগম বলেন, রবিউলের সাত-আট বছর বয়সে জ্বর হয়েছিল। অসুস্থতার পর আস্তে আস্তে তাঁর হাত-পা শুকিয়ে যেতে থাকে। পরিবারের সাধ্যমতো ডাক্তার-কবিরাজ সব দেখানো হলেও আর সুস্থ্য স্বাভাবিক হয়নি সে। এখন শীত-গরম কোন অনুভূতিই তাঁর শরীরে নেই। তাই শরীরে কখনোই কোন কাপড় রাখে না রবিউল।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রবিউলের মা আরও বলেন, ‘পাগল বলে ছাওয়ালডারে মাইরে ফেলাই নাই। খাওন দাওন দিয়ে ওরে বাঁচাইয়ে রাখছি, এখন আল্লাহ এই ভাবেই ওরে যতদিন দুনিয়ায় রাখে। রবিবারে জন্ম হইছিলো তাই ওর ফুপু রবিউল নাম রাখছিলো। সন্ধ্যা হলি আমি আর আলাদা ঘরে টিকতি পারিনে, কেননা ছাওয়ালের জন্যি খালি মন কাঁন্দে।’
বাবা মো. নুরুল মোল্লা বলেন, ‘রবিউল অসুস্থ্য হওয়ার পর ছাওয়াল ওজনে টাকা ঢালেও তারে ভাল বানাতি (সুস্থ) পারি নেই। এহন আল্লাহর ওপর ছাইড়ে দিছি।’ তিনি জানান, শেকল খুলে দিলে রবিউল পুরো বাড়ি ভাঙচুর ও তছনছ করে। এদিক ওদিক হারিয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে মনে না মানলেও প্রায় ১৫ বছর ধরে ওকে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি।
স্মৃতি হাতড়ে ছোট ইমরান মোল্লা বলেন, প্রায় পনের বছর আগে বড়ভাই নিজে আমাকে বাইসাইকেল চালানো শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রতিবেশী চরবর্ণি গ্রামের কৃষক মো. মুন্নু মিয়া (৬০) জানান, রবিউল সুস্থ থাকা অবস্থায় হাসিখুশি ও খুব পরিশ্রমী ছিল। সাইকেল চালাতো, আমাদের সাথে মাঠে সারাদিনে অন্য শ্রমিকের তুলনায় তিন-চার গুন বেশি কাজ করতে পারতো সে।
পৌরসভার ছোলনা গ্রামের মাস্টার্স পড়ুয়া যুবক মো. হেদায়েতুর রাফির ফেসবুকে শেকল বন্দী রবিউলের একটি ছবির পোস্ট দেখে বিষয়টি জানাজানি হয়। তিনি জানান, আমি সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু আমার সাধ্য সীমিত। ঈদের পর দিন আমি নিজে এসে পরিবারটিকে কোরবানির মাংস দিয়ে গেছি। রবিউলের থাকার পরিত্যক্ত ওই ঘরটিতে একটি ফ্যানও লাগিয়ে দিব।সমাজের বিত্তবানেরা এগিয়ে আসলে রবিউলকে নিয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)এর বোয়ালমারী শাখার সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট গাজী শাহিদুজ্জামান লিটন জানান, দীর্ঘদিন ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন রবিউলের চিকিৎসায় আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র বা সমাজ কেউই সেভাবে এগিয়ে আসেনি। আমাদের মানবতা সত্যিই এখানে বিপন্ন।
ময়না ইউপি চেয়ারম্যান নাসির মো. সেলিম বলেন, প্রায় তিন বছর আগে আমরা মানসিক ভারসাম্যহীন রবিউলকে একটি প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দিয়েছি। এখন রবিউলের চিকিৎসায় বড় অংকের টাকা প্রয়োজন কিন্তু আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের এ ধরনের কোন তহবিল নেই।
এ ব্যাপারে উপেজেলা নির্বাহ কর্মকর্তা (ইউএনও) ঝোটন চন্দ গতকাল শুক্রবার (৩০.০৭.২০২১) জানান, ফেসবুকে শেকল বন্দি ওই তরুণের ছবি দেখে ইতিমধ্যে আমি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে পরিবারটিকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা ও সরকারি খাদ্য সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।তিনি আরও জানান, এলাকাটি প্রত্যন্ত হওয়ায় ঘটনাটি আগে আমাদের নজরে আসেনি বা কেউ জানায়নি। এখন সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে মানসিক ভারসাম্যহীন রবিউলের চিকিৎসায় বড় ধরনের অর্থ সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হবে।