মিতু হত্যাকান্ডের ৫ বছর, এখনো নিখোঁজ দুই আসামি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:৪৬ পিএম, ৫ জুন,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:৩৫ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর মাহমুদা খানম মিতু হত্যায় পেরিয়ে গেল ৫টি বছর। ৫ বছরে একের পর এক নাটকীয় মোড় নেয় ঘটনাটি। ২০১৬ সালের আজকের এই দিনে চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের কোপ আর গুলিতে খুন হন সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মিতু। ঘটনার পরপর দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি এই মামলার তদন্ত।
পুলিশের একজন এসপির স্ত্রীকে কে, কারা এবং কেন নৃশংসভাবে হত্যা করলো এসবের কোন কূল কিনারা বের করতে না পারলেও দীর্ঘদিন পর একে একে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ঘটনার আদ্যোপান্ত।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার ওআর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ওই বছরের আগস্টে বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। এরপর মামলার তদন্তে গতি আসে। ১৫ মাস পর গত ১১ মে বাদী বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে নেয় পিবিআই। তবে এর আগেই ঘটনার সঙ্গে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। পরদিন আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয় বাবুল আক্তারের মামলার।
এই মামলার তদন্ত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাবুলের বিশ্বস্ত সোর্স কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা ও মো. কালু নামে দু’জনের সন্ধান পাওয়ার কথা বলে আসছিল পুলিশ। কিন্তু তারা দু’জন রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ আছেন। যদিও মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার বলছেন, তার স্বামীকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে। তবে মুসা ও কালুর বাইরে এখন আরো গুরুত্বপূর্ণ দু’জনের সংশ্নিষ্টতার কথা বলছে মামলার বর্তমান তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। তাদের সন্ধান পাওয়া গেলেই মিতু হত্যার চার্জশিট দেয়া যাবে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
২০১৪ সালে কক্সবাজারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে যোগ দেয়ার পর গায়ত্রী অমর সিং নামের এনজিও কর্মকর্তার সাথে সম্পর্ক ও পরকিয়ার জেরে মিতু হত্যাকান্ড ঘটেছে অন্তত এখন পর্যন্ত পাওয়া তদন্ত রির্পোট ও মিতুর বাবার দাবি এটাই। গায়ত্রীর সঙ্গে অনৈতিক প্রেমের বিষয়টি প্রথমে মিতু আঁচ করতে পারলেও পরে গায়ত্রীর দেয়া দু’টি বই এবং বইতে থাকা কিছু লেখা থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হন তিনি। এসব নিয়ে ঝগড়া-বিবাদের পাশাপাশি মিতুকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতনের পাশাপাশি বাবুল আক্তার মিতুকে ডিভোর্স দেয়ারও হুমকি দেন। কিন্তু তার সব অপকর্ম প্রকাশ্যে জানিয়ে দেবেন বলে মিতু উল্টো হুমকি দিলে বাবুল মিতুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন বলে জানান মিতুর বাবা।
মিতুকে হত্যার জন্য মুছাসহ কিলিং স্কোয়াডকে ৩ লাখ টাকায় কন্ট্যাক্ট করেন বাবুল আক্তার। পরিকল্পনা জানালে মুসা প্রথমে রাজি না হলেও বাবুল আক্তারের চাপে শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হয় মুসাকে। বাবুলের ব্যবসায়িক পার্টনার সাইফুলকে ৩ লাখ টাকা প্রয়োজন বলে জানান বাবুল। সাইফুল এই টাকা দেন আল মামুন নামের একজনকে যা মামুন পরে বিকাশের মাধ্যমে মুসাকে দেন। বাবুলকে গ্রেপ্তারের আগে সাইফুল এবং আল মামুন এসব ঘটনা নিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দীও দেন। যেখানে তারা বিকাশের মাধ্যমে অর্থ প্রদানের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে মুসাকে কেন এই টাকা দেয়া হয়েছে তা তারা জানেন না।
মুসার পরিচয়- দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মুসা মূলত আন্ডারওয়ার্ল্ডের সদস্য। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও হাটহাজারীতে বাবুল আক্তারের কর্মরত অবস্থায় মুসা ছিলেন তার সোর্স। মিতুকে হত্যায় বাবুল তাকে দিয়েই পরিকল্পনা করিয়েছেন যা সকলের কাছেই ওপেন সিক্রেট। কিলিং স্কোয়াডের অন্যান্য সদস্যরা স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, মিতুকে হত্যার জন্য মুসাই তাদেরকে ৩ লাখ টাকায় ভাড়া করেছিল। শুধু তাই নয়, হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র এবং মোটরসাইকেলও কিনেছিল মুসা।
গত ৩১ মে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার। সেখানে তিনি জানান, তার স্বামী পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। বাবুল আক্তারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। যেদিন মিতু খুন হন সেদিন সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার দিকে পরিবারের সদস্যদের জন্য পরোটা ও হালুয়া নিয়ে আসেন মুসা। টিভিতে মিতু হত্যার ঘটনা দেখছিলেন পান্না। এরপর তিনি স্বামীর কাছে জানতে চান, মিতুকে দেখতে যাবেন কিনা। উত্তরে মুসা বলেন, বাবুল আক্তার ঢাকা থেকে ফিরলে দেখতে যাবেন।
পান্না আরো জানান, হত্যার আগের দিন সন্ধ্যায় ভাড়া বাসায় তার স্বামীর কাছে কিছু লোক আসে। তাদের তিনি চেনেন না। তবে বাসায় আসার পর তাদের খেতে দেন। মিতু হত্যার দু’দিন পর পান্না তার বাবার বাড়ি রাঙ্গুনিয়া চলে যান। কারণ তখন বাবার অসুস্থতার খবর পান তিনি। এর দু-এক দিন পর মুসাও রাঙ্গুনিয়া যান। সাত-আট দিন পর মুসার টিঅ্যান্ডটি ফোনে একটি কল আসে। ফোনটি রিসিভ করে পান্না জানান, মুসা ঘরের বাইরে রয়েছেন। ফোনের ওপাশ থেকে বলা হয়, মুছা যেন সাবধানে থাকে। তবে ফোন করা ব্যক্তি নিজের পরিচয় দেননি।
পান্না বলেন, ২০১৬ সালের জুন মাসের ১৯ বা ২০ তারিখের দিকে মুসা ফোনে কাউকে বলেন, ‘স্যার আমি তো এটা করতে চাইনি। আমার ফ্যামিলির যদি সমস্যা হয় তাহলে পুলিশের কাছে মুখ খুলব।’ তখন পান্না তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন, কে ফোন করেছিল? উত্তরে মুসা জানান, বাবুল আক্তার। এরপর পান্না মুসার কাছে জানতে চান, মিতু হত্যার ঘটনার তিনি জড়িত কি না। উত্তরে মুসা জানান, তাকে এই কাজে জড়িত থাকতে বাধ্য করেছেন বাবুল আক্তার। ২১ জুন মুসা তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কাঠঘর এলাকায় নুরুন্নবী নামে এক গাড়িচালকের বাসায় যান। ২২ জুন মুসাকে ডিবি পরিচয়ে ধরে নেওয়া হয়।
মুসাকে গ্রেপ্তারের সময় সাদা পোশাকধারী সিএমপি’র দু’জন ওসিকে চিনতে পেরেছেন বলেও পান্না দাবি করেন। ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিশ্চিত করতে পারবেন যে তার স্বামী মুসা কোথায় আছে। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মুসাকে খুঁজে পাওয়া গেলেই মিতু হত্যার সকল রহস্যের জট খুলে যাবে।
দুই পুলিশ কর্মকর্তা কোথায় মিতু হত্যাকান্ডের অন্যতম কুশীলব কামরুল ইসলাম শিকদার মুসার অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ বলছে মুসা পলাতক। তবে মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি- মিতু হত্যার ১৭ দিন পর ২০১৬ সালের ২২ জুন ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কিছু লোক তার স্বামীকে নগরীর কাঠগড় এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে।
এর আগে তার স্বামী পতেঙ্গার নুরুন্নবী ড্রাইভারের বাসায় রাত কাটিয়েছিলেন। সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর ডিবির পরিদর্শক মহিউদ্দিন সেলিম ও পরিদর্শক নিজাম উদ্দিন তার স্বামীকে আটক করে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পরিদর্শক মহিউদ্দিন সেলিম বর্তমানে চট্টগ্রাম পিবিআইতে কর্মরত। আর পরিদর্শক নিজাম উদ্দিন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতয়ালি থানার ওসি’র দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও পুলিশ মুসা গুমের সঙ্গে এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বারবার অস্বীকার করে আসছে।